সুনামগঞ্জে বিলুপ্তির পথে দেশীয় পাখি

, ফিচার

আল হাবিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সুনামগঞ্জ | 2023-08-31 04:38:52

হাওরে বাওড়ের জেলা সুনামগঞ্জ। এই সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক নজর দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন হাজারও পর্যটক। এখানেই শেষ নয়, এক সময় সুনামগঞ্জকে দেশীয় পাখির রাজ্যও বলা হতো।

কারণ সুনামগঞ্জ ছিল দেশীয় পাখির রাজ্য। ভোর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পাখির মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজ মুগ্ধ করত সবাইকে। এমনকি গ্রামগঞ্জের খেড়ের চালের উপর বাসা বেধে থাকত দেশীয় পাখিরা। কিন্তু বর্তমান আধুনিক যুগে গ্রামগঞ্জের বাসা বাড়ি আধুনিক হচ্ছে সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় পাখির আশ্রয়ের ঠিকানা।

আর যে খাবারের সন্ধানে পাখিগুলো ভোর সকাল থেকে বের হয়ে গ্রাম সবুজ মাঠের ফসলের চারদিকে ঘুরে বেড়াত কিন্তু আধুনিক যুগে সেখানে ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার দেশীয় পাখির বিলুপ্তি অনেকাংশেই দায়ী।

গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাখির কিচির মিচির ডাকে এখন ঘুম ভাঙেনা আমাদের। গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই ঝাউ-জঙ্গল কেটে ফেলছে। সবার ঘর বাড়ি মাটির ঘর থেকে দালান ঘরে নির্মাণ করছে।

ফলে পাখিরা হারিয়ে ফেলছে তাদের চিরাচরিত বাসস্থান। গ্রামের মুরুব্বিরা বলেন, আগেও মাঠ-ঘাট, ক্ষেতে-খামারে বিচিত্র ধরণের পাখিদের বিচরণ ছিল।পাখিরা সেসময় ঝাঁকে ঝাঁকে এসে তৃষ্ণা মেটাতো আর খাদ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতো। ফসলের মাঠে পাখি বসার দৃশ্য সচরাচর দেখা গেলেও এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে।

অতীতে গ্রাম এলাকায় ব্যাপকহারে টুনটুনি, চিল, পানকৌড়ি, ডাহুক, বালীহাঁস, কোকিল,বক, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, বাবুই, কাকসহ বিভিন্ন পাখিদের দেখা যেত। বর্তমানে জাতীয় পাখি দোয়েল, কাঠ ঠোকরা, কোকিল, ডাহুক, ক্যাসমেচি, বাবুই, ঘুঘু, বাওয়াই, শালিক, টুনটুনি, মাছরাঙা, বটর, টেইটেরা, গোমড়া ও প্যাচাসহ অনেক পাখিকে আর দেখা যায়না। শোনা যায় না এসব পাখির ডাক।

গ্রামবাংলার অতি পরিচিত বসন্তে যে পাখি ‘বউ কথা কও’ বলে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে মাতিয়ে তুলতো সেই পাখির দেখাও আর পাওয়া যায়না। ফলে বর্তমান প্রজন্মরা চেনেনা এসব পাখি। এসব পাখির ডাকও শোনেনি কোনদিন। ফলে শিশু কিশোরদের কাছে দিন দিন হয়ে যাচ্ছে এসব পাখি ইতিহাস।

বিশেষজ্ঞরা জানান, গ্রামগঞ্জের ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার পাখি বিলুপ্তির অনেকাংশেই দায়ী। কৃষকরা এখন বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে সব সময় কীটনাশক প্রয়োগ করে। এতে করে পাখির খাদ্য ফড়িং, ফুতি, প্রজাপতি, মশা, লেদা পোকা, গোয়ালীসহ বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ মরে যায় বা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। পাখিরাও দিনের পর দিন এসব খেয়ে মারা যাচ্ছে।

তাছাড়া পাখি শিকারীদের নিষ্ঠুরতা তো রয়েছেই। কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঝড়ে পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখির ছানার মৃত্যু ঘটে ও ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। পাখির বিলুপ্তি ঘটায় যেমনি জীববৈচিত্রের সংকট বাড়ছে, তেমনি আমরা হারিয়ে ফেলছ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই কেবল আমাদের দয়া, সহনশীলতা এবং সচেতনতাই রক্ষা করতে পারে পাখির স্বাভাবিক বেঁচে থাকা।

গ্রামের বাসিন্দা খাইরুল মিয়া বলেন, আমার বয়স এখন ৭৯ বছর, যখন আমার বয়স ১০ বছর ছিল তখন আমাদের গ্রামে কত রঙের পাখি ছিল বলে শেষ করতে পারব না। ঘরের চালের উপর পাখিরা বাসা বেধে থাকত। পাখির শব্দে ঘুম ভাঙত আমার। অথচ এখন আর সেই পাখিগুলো নেই।

গ্রামের বাসিন্দা রহিম মিয়া বলেন, আগে যখন আমরা মাঠে ফসল ফলাতাম তখন পাখিরা চারদিকে বসে থাকত, আর মিষ্টি কন্ঠে কত রকমের ডাক ডাকত। কিন্তু মাঠ আছে, ফসল আছে, গ্রাম আছে অথচ সেই পাখিগুলো নেই।

গ্রামের বাসিন্দা ঝুনাকি বেগম বলেন, আগে যখন আমরা পুকুর থেকে পানি আনতাম তখন পুকুরের চারপাশে কত পাখি থাকত, পাখিরা কিচির মিচির করত আর আমরা কলস ভরে পানি নিয়ে আসতাম। অথচ এখন সেসব পাখিগুলো দেখা যায় না।

বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুমেল আহমেদ বলেন, আসলে এখন গ্রামের চারদিকে ঘনবসতি বেড়ে উঠছে। ফলে পাখিরা তাদের আশ্রয়স্থল হারাচ্ছে। শুধু তাই না ফসল ভালো করার জন্য কৃষকরা বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করেন সেগুলো খেয়েও অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। ফলে পাখি রক্ষার্থে আমাদের সবাইকে একত্রিত কাজ করতে হবে। প্রশাসন বলুন আর রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব বলুন সবাই যদি একত্রিত মিলে কাজ করেন তাহলে বোধহয় কিছুটা হলে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ গ্রামগঞ্জে শোনা যাবে।

এদিকে শীতের শুরুতেই সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে ঝাঁক বেঁধে আসা অতিথি পাখির শব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরের পাড়ের মানুষের ঘুম ভাঙতো। বোঝা যেতো হাওরে অতিথি পাখি আসছে। পাখিরা দল বেঁধে এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে উড়াল দিলে ঝড়ের মতো শব্দ বাড়ি থেকে শোনা যেত। কিন্তু এ শব্দ গত কয়েক বছর ধরেই আর পায় না হাওর পাড়ের মানুষ। হাওরের পাখি কম আসার প্রধান কারণ হচ্ছে পাখি শিকারীরা অবৈধভাবে রাতের আধারে পাখি শিকারের নিষ্ঠুরতাকে দোষছেন তাহিরপুরবাসী।

আইইউসিএনের পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় প্যালাসিস ঈগল রয়েছে। কালেম, পানকৌড়ি, ভূতিহাঁস, পিয়ংহাঁস, খয়রাবগা, লেঞ্জাহাঁস, নেউপিপি, সরালি, রাজসরালি, চখাচখি, পাতি মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা, মরিচা ভূতিহাঁস, সাধারণ ভূতিহাঁস, শোভেলার, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, ডাহুক, বেগুনি কালেম, গাঙচিল, শঙ্কচিল, বালিহাঁস, ডুবুরি, বক, সারসসহ প্রায় ২১৯ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি।

এ ছাড়া ২০১১ সালের জরিপে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৬৪ হাজার পাখির অস্তিত্ব ছিল। এতে ৮৬ জাতের দেশি এবং ৮৩ জাতের বিদেশি পাখি ছিল। যার দেখা বর্তমান সময়ে একবারেই মিলেনা।

টাঙ্গুয়া হাওর পাড়ের বাসিন্দা খলিল মিয়া বলেন, অতিথি পাখি প্রতি বছর ডিসেম্বরের শুরুতে দল বেঁধে হাওরে জলেকেলি করে। দল বেঁধে কান্দা জাঙ্গালের গাছের ডালে ডালে সঙ্গিনী নিয়ে ওড়াওড়ি করে। অথচ গত কয়েক বছর পাখিই আসেনা টাঙ্গুয়ার হাওরে।

টাঙ্গুয়া হাওর পাড়ের বাসিন্দা ফজু মিয়া বলেন, আমরা ছোট বেলা কত জাতের পাখি যে এই টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখিছি তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে বর্তমান সময়ে হাওরে একবারেই পাখি আসেনা।

টাঙ্গুয়া হাওর পাড়ের বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, আগে টাঙ্গুয়ার হাওরে অতিথি পাখির পাশাপাশি দেশীয় পাখির ভরপুর ছিল অতচ এখন শীত মৌসুমে অতিথি পাখির দেখা মিললে দেশী পাখি বিলুপ্তি হয়ে গেছে।

টাঙ্গুয়া হাওর পাড়ের বাসিন্দা আজাদ মিয়া বলেন, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, হিমালয়, উত্তোর এশিয়া, নেপালসহ পৃথিবীর নানা শীতপ্রধান দেশ থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অতিথি পাখিরা বাংলাদেশের বৃহৎ জলমহাল টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। এসব পাখির মধ্যে লেঞ্জা, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশির, পানকৌড়ি, পাতারি, দলপিপি, রাঙ্গামুড়ি, পান্তামুখী প্রভৃতি পাখি ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত অবস্থান করে হাওরে। অতচ পাখি শিকারীদের নিষ্ঠুরতা কারণে এইসব পাখিও এখন আর হাওরে আসেনা।

বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুমেল আহমেদ বলেন, হাওরের পাখি শিকারীদের সাজা দিয়ে কোন লাভ হবে না। কারণ পেটের তাগিদে তারা সাজা কেটে আবারও সেই পাখি শিকার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যদি পাখি শিকারীদের নির্দিষ্ট কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো তাহলে হয়ত টাঙ্গুয়ার হাওরে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে টাঙ্গুয়ার হাওরে বেশি বেশি পাখি আসত।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে অতিথি পাখি যাতে কেউ শিকার না করতে পারে সেজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্টদের নীবিড়ভাবে হাওর তদারকি করতে নির্দেশ দেয়া আছে। যেই পাখি শিকার করবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর