নামকরণ আর নাম বদলের হিড়িক পুরনো আর নতুনের সঙ্গে একটা অনিবার্য দ্বন্দ্ব তৈরি করে। ধর্ম, রাজনীতি, উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে নাম বদলানো হলেও আপামর জনতা লোকশ্রুতি ও লোকপ্রিয় নামকেই মনে রাখে। ফলে দিল্লির আওরঙ্গজেব রোডের নতুন নাম কেউ জানে না। কলকাতায় এমজি রোড (মহাত্মা গান্ধি রোড) অচল হয়ে পড়ে পুরনো হ্যারিসন রোডের আড়ালে। অগ্রবন বা প্রয়াগরাজ নয়, মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আগ্রা ও এলাহাবাদেই।
কলকাতা গেলেই পুরনো আর নতুন নামের দ্বৈরথে বিভ্রান্ত হতে হয়। বহু জায়গা, রাস্তা, এলাকা লোকে বলে এক রকম আর সাইনবোর্ডে লেখা আরেক রকম। হয়ত নতুন নাম আছে বিভিন্ন স্থাপনায় লেখা, কিন্তু মানুষের মুখে মুখে ফিরছে পুরনো নাম।
নামকরণ আধুনিক নগর বিন্যাস ও পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার নাম বদলও চলমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পালাবদলের লক্ষণীয় দিক। এসব নিয়েই একটি শহর ও শহরের নাগরিকগণ জীবন-যাপন করেন। প্রাচীন শহর কলকাতার ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে।
ব্রিটিশ বাংলায় ১৮৭৬ সালে ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কনসলিডেশন অ্যাক্ট’ আইন হলে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় পথ নির্মাণ ও তার নামকরণের কাজও দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে। আর এই নামকরণের মধ্য দিয়ে শহরের এক বিশেষ চরিত্র ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, আঞ্চলিকতার মিশেলে জন্ম নেয় পথের নামকরণের এক বিশেষ ধারা।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইংরেজদের মুখ্য ভূমিকা থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতার বাছাই করা পথের নামকরণ বড়লাট, ছোটলাট বা ঐ ধরনের ইংরেজ কেউকেটাদের নামে হওয়াই স্বাভাবিক ছিল এবং হয়েছেও তাই। অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত ছিল এমন ইংরেজদের নামের পাশাপাশি ইহুদি, জার্মান, পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ানদের নামও খুঁজে পাওয়া যায়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য-কুঠি যিনি কলকাতায় প্রথম গড়লেন, সেই জোব চার্নকের নামে এখন কোনও রাস্তা না থাকলেও, আগে ছিল—চার্নক প্লেস। ক্লাইভের নামে রাস্তা ছিল—ক্লাইভ স্ট্রিট, সেই নাম পাল্টে এখন নেতাজী সুভাষ বসু রোড হয়েছে। মধ্য কলকাতায় ব্রিটিশ আমলের লর্ড বেন্টিঙ্ক, জেনারেল আউটরাম, বড় ব্যবসায়ী উইলিয়াম ফেয়ারলি, সেকালের বাণিজ্য পর্ষদের সভাপতি স্যামুয়েল মিডলটনের নামে যথাক্রমে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, আউটরাম রোড, মিডিলটন রোড রয়েছে। তবে ব্রিটিশ আমলে দেওয়া অনেক পথের নাম পাল্টে দেশীয় লোকজনদের নাম বসানো হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের নবাবদের কথা মনে করানো ‘নবাবপট্টি স্ট্রিট’ বাদে খাস নবাবদের নামে তেমন কোনও পথ না থাকলেও দাক্ষিণাত্যের টিপু সুলতান ও কলকাতায় চলে আসা তার ছেলেদের নামে 'প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড' আছে দক্ষিণ কলকাতায়। রাজা-মহারাজাদের মধ্যে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের মতো রাজার নামে পথ কমই আছে। যা আছে তার বেশিরভাগই উপাধি পাওয়া—রাজা রামমোহন রায় তেমনি এক গরম উদাহরণ। আগেকার বিখ্যাত আমহার্স্ট স্ট্রিটের নাম বদলে রাখা হয়েছে রাজা রামমোহন রায় রোড।
রাজা-মহারাজা-প্রভাবশালীদের পাশাপাশি নানান পেশায় থাকা অতি সাধারণ মানুষের নামেও পথ আছে। শিক্ষাবিদ হিসেবে বিদ্যাসাগর এবং স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম আছে। আছে দেশ-বিদেশের বিপ্লবী, রাজনৈতিক নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম—লেনিন, হো-চি-মিন, সূর্য সেন, পুলিন দাস, বিনয়, বাদল, দীনেশ। রয়েছে মির্জা গালিব, রফি আহমেদ কিদোয়াই, আলীমুদ্দীন স্ট্রিটও।
কলকাতার পথনামের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে বড়ো পরিবারের বংশ পরম্পরায় নাম রাখা। এর অব্যর্থ উদাহরণ- ঠাকুরবাড়ি। দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের নামে পথ আছে। পোস্তার রাজা রাজনারায়ণ, ছেলে রাজা ব্রজেন্দ্র, নাতি দীনেন্দ্রর কথাও এ ক্ষেত্রে বলা যায়।
কলকাতার পথের নামের মধ্যে ডাক্তার-বদ্যির পাশাপাশি হেকিমি চিকিৎসকরাও রয়েছেন। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার বিধান রায়, গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জি, হোমিওপ্যাথ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের পাশাপাশি কবিরাজ শ্যামাদাস বাচস্পতি, হাকিমি চিকিৎসক আজমল খানকে খুঁজে পাওয়া যায়। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, গিরিশ অ্যাভিনিউ, কৃত্তিবাস রোড, কালীপ্রসন্ন সিংহ স্ট্রিট, সত্যজিৎ রায় সরণি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরণি, প্রমথেশ বড়ুয়া সরণি, ওস্তাদ এনায়েৎ খান অ্যাভিনিউ, আচার্য জগদীশ্চন্দ্র বসু রোড, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড, পি সি সরকার সরণির মতো পথগুলো সাহিত্যিক, নাট্যকার, পরিচালক, সঙ্গীত শিল্পী, বিজ্ঞানী, কৃতি জাদুকরের নাম বহন করে চলেছে। প্রখ্যাত কুস্তিগীর গোবর গুহ’র নামেও পথ আছে কলকাতায়। আছে জাঁদরেল পুলিশকর্তা জন ইলিয়টের নাম বহনকারী ইলিয়ট রোড, তেমনই মনোহর পুকুর রোড বহন করে চলেছে মনোহর ডাকাতের নাম; চোরবাগান, চোরাবাজারও আছে।
পথনামের ক্ষেত্রে কলকাতা জাতপাত, শ্রেণী, বর্ণের প্রভাবও লক্ষণীয়। মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, বসু, মিত্র জাতীয় উচ্চ বর্ণের পদবী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কলকাতার পথের নামে এখনও বেঁচে আছে বৃন্দাবন বসাক স্ট্রিট, রামমোহন বেরা লেন, গোপী মণ্ডল লেন, তারক প্রামাণিক রোড। পাঁচি ধোবানির গলি, অখিল মিস্ত্রি লেন, গুলু ওস্তাগর লেন, হিংগন জমাদার লেন, চমরু খানসামা লেন-এর মতো পথগুলোও।
ইংরেজ, পর্তুগিজ, ইতালি, ইহুদি, চীন, ভিয়েতনাম, আর্মেনিয়ান, পার্সি মানুষের নাম যেমন পাওয়া যায় কলকাতার পথনামের মধ্যে, তেমনি পাওয়া যায় পাঞ্জাব, কাশ্মীর, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্যের মানুষের নাম। এ শহর আয়তনে যত বেড়েছে, বেড়েছে তার হৃদয়ও। কলকাতার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অভিন্ন অংশ কলকাতার পথনাম, এ এক অন্য জগৎ, যার নেপথ্যে লুক্কায়িত সুরম্য ইতিহাসের নানা রোমাঞ্চকর আখ্যান।