একদিন চলে যাবো দূরে, বহুদূরে

সুরতাল, বিনোদন

প্রভাষ আমিন | 2023-08-30 20:08:47

সকালে অফিস থেকে ফোন করে গনি আদম যখন বললেন, দাদা! একটা দুঃসংবাদ দিয়ে দিন শুরু করবো। আমি মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ শোনার জন্য। আমার সরাসরি শিক্ষক মমতাজ স্যার অসুস্থ। বেশ কয়েকদিন ধরে অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন। কিন্তু গনি আদম যেটা জানালেন, সেটা অবিশ্বাস্য। আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, গনিও নয়। গনি জানালেন, তিনি শুনলেও বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই ব্রেকিং দিতে পারছেন না। আমি ফোন করলাম এরশাদুল হক টিঙ্কুকে। কান্নাভেজা কণ্ঠে টিঙ্কু নিশ্চিত করলেন, আইয়ুব বাচ্চু আর নেই।

কী রকম অবিশ্বাস্য কথা। মাত্র ৫৬ বছর বয়স। একদিন আগেও রংপুরে কনসার্ট করে এসেছেন। একদিন পর যাওয়ার কথা ছিল রাজশাহীতে। আর মাঝখানে তিনি কিনা আকাশের তারা হয়ে গেলেন। সবাইকে একদিন যেতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের যাওয়া বড় বেশি শূন্যতা তৈরি করে। কিছু শূন্যতা আসলেই পূরণ হয় না। আইয়ুব বাচ্চু তেমনই একজন। শুধু বাংলাদেশ নয়, আইয়ুব বাচ্চু উপমহাদেশেরই অন্যতম সেরা গিটারিস্ট। আইয়ুব বাচ্চুর অসময়ে চলে যাওয়া আমাদের হৃদয়ে হাহাকার তৈরি করে।

স্বাধীনতার পর শুরু হয় দেশ গড়ার সংগ্রাম। সবাই যার যার অবস্থান থেকে লড়াই করছিলেন। শিল্পীদের লড়াইটা ছিল বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব গান গড়ার। আজম খান, ফিরোজ সাই, ফেরদৌস ওয়াহিদরা আনলেন নতুন ধরনের পপ গান। এর পর আসে ব্যান্ড গান। আশির দশকজুড়েই ছিল ব্যান্ড গানের জোয়ার। এই জোয়ারে সবচেয়ে বড় স্রোতটা আসে চট্টগ্রাম থেকে। সোলস নিয়ে আসে এক ঝাঁক শিল্পী। আইয়ুব বাচ্চু, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, নকীব খান, নাসিম আলী খান, পার্থ বড়ুয়া- থোকা থোকা সব নাম। চট্টগ্রামের এই শিল্পীরা পরে দখল করে নেন গোটা বাংলাদেশ। সুরের আকাশে একেকজন মহাতারকা।

আশির দশকে ব্যান্ড গানের সেই জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু আস্তে আস্তে পেশাগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় ব্যান্ড গান আর সেভাবে ফলো করা হয়নি। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু যে নিজেকে ভেঙ্গেচুড়ে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা চোখের সামনেই দেখেছি। নব্বই দশকের শুরুতে এলআরবি দিয়ে শুরু হয় আইয়ুব বাচ্চুর নবযাত্রা। আইয়ুব বাচ্চু শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশেরই অন্যতম সেরা গিটারিস্ট।

ইদানীং ব্যান্ড গান শুনলে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। যন্ত্রের আধিক্যে গান বোঝা যায় না। এই ভীড়ে আইয়ুব বাচ্চু দারুণ ব্যতিক্রম। আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনতে গেলেই চমকে যেতাম, গানের কথায় কী দারুণ কাব্যময়তা, কী অসাধারণ আধ্যাতিকতা। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে বা হাসতে দেখো, গাইতে দেখো বা এক আকাশের তারা বা এখন অনেক রাত কোনটা ফেলে কোনটা শুনবেন।

আমরা যারা পঞ্চাশে পা রেখেছি, তারা আইয়ুব বাচ্চুকে ঠিক বুঝতে পারবো না। তরুণ প্রজন্মের ওপর আইয়ুব বাচ্চুর প্রবল প্রভাব। তাদের কাছে তিনি আইডল, প্রিয় এবি।

আরেকটা কারণে আইয়ুব বাচ্চুকে মিস করবে সঙ্গীতাঙ্গন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও কোনো শিল্পী অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে ছুটে যেতেন তিনি। এমন আরেকজন আইয়ুব বাচ্চু কোথায় পাওয়া যাবে?

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবরে শোকের ঢেউ দেখে চমকে গেছেন অনেকেই। ঢুকতে পারবে না জেনেও হাসপাতালের সামনে হাজারো ভক্তের ভিড়। একজন শিল্পীর এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে। একজন শিল্পীর আসলে মৃত্যু নেই। আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে থাকবেন তার গানে।

আইয়ুব বাচ্চু গেয়েছিলেন, 'এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে/সেদিন অশ্রু তুমি রেখো/গোপন করে... ' কিন্তু রূপালী গিটার ফেলে যেদিন তিনি দূর আকাশের তারা হয়ে গেলেন, কেউ অশ্রু গোপন করতে পারেনি। সঙ্গীতপ্রেমীদের বুক জুড়ে হাহাকার, কান্না।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর