জনশুমারিতে সংখ্যায় বেশি, ভোটার সংখ্যায় পিছিয়ে নারীরা

, নির্বাচন

জাহিদ রাকিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-03-02 06:57:41

৯ বছর আগে রাজধানীর মধুবাগে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে চার সন্তানের জননী শিল্পী আহমেদের (৩৫) টিনশেড ঘরটি পুড়ে যায়। তার কিছুদিন পর স্বামী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে। তারপর থেকে সন্তানদের নিয়ে একাই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। 

শিল্পী আহম্মেদ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ধর্মীয় রীতি পালন করি, ছবি তুলতে হবে তাই আমি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) করিনি। অগ্নিকাণ্ডে ঘর পুড়ে যাওয়ার পর সবাই সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ-সহযোগিতা পেলেও এনআইডি না থাকায় কোনো সহায়তা পাইনি।

শিল্পী আহম্মেদের মত ঢাকার মোমিনবাগের বাসিন্দা শরীয়তপুরের উম্মে কুলসুম কুসুম (৩৮) বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। ছয় নাবালক সন্তান রেখে স্বামী মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। মুখচ্ছবি দিতে সম্মতি না দেওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি। কোথাও কাজ নিতে গেলে সবাই আগে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখতে চায়।

নানাবিধ কারণে শিল্পী আহম্মেদ ও উম্মে কুলসুমের মত এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন করেননি। ফলে নাগরিক সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন এনআইডি না নেওয়া নারীরা। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জনশুমারির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে নারীর সংখ্যা বেশি হলেও ইসির ভোটার তালিকায় বেশি পুরুষ ভোটার সংখ্যা। সেখানে দেখা যায়, ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন জনসংখ্যায় পুরুষ রয়েছে ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ৩ জন। নারীর সংখ্যা আট কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন, নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। সেই হিসেবে পুরুষ ভোটারের তুলনায় নারী ভোটার ১৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৭ ভোটার কম।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসংখ্যায় যেহেতু নারীর সংখ্যা বেশি, স্বাভাবিকভাবে নারী ভোটারও বেশি থাকার কথা। কিন্তু কিছু লোকের ধর্মীয় বিশ্বাস, ছবি তুলতে অসম্মতি, এনআইডির গুরুত্ব নিয়ে প্রচারের অভাব, নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আগ্রহ বা সুযোগের অভাব ভোটার সংখ্যায় ওই উল্টো চিত্রের কারণ ঘটাতে পারে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বার্তা২৪.কম-কে বলেন, নারীরা নানান কুসংস্কার বিশ্বাস করে বিধায় এখনো কেউ কেউ ভোটার হচ্ছে না। সমাজে নারীদের পিছিয়ে রাখার জন্য একটি মহল কাজ করছে, যাতে নারীরা এগিয়ে যেতে না পারে। এর পেছনে পরিবার ও সমাজ নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে ভোটার হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

তিনি আরও বলেন, ধর্মের নামে মিথ্যা অজুহাত দিয়ে অনেক নারী এনআইডি গ্রহণ করছেন না। ফলে রাষ্ট্র নারীকে যে অধিকার দিয়েছে, সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা চাই, সকল নারী যেন এনআইডি গ্রহণ করুক। সেখানে যেন কো নো পশ্চাৎপদ চিন্তা ভাবনা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে ওঠে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে।

২০০৭-২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা কার্যক্রম হাতে নেয় তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। সেই সময় ৯ কোটি ভোটারের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর এ পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে সাতবার। ২০২১-২২ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে ইসি। ছবিসহ ভোটার তালিকা শুরুর পর থেকে নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান থাকলেও গত ১৫ বছরে হালনাগাদে নারী ভোটারদের সাড়া মিলেছে কম।

এমন পরিস্থিতিতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা নারী ভোটার না হওয়ার একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছিলেন। সেখানে দেখা যায়, নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহে অনীহা, হিন্দু অবিবাহিত মেয়েদের পিত্রালয়ে নিবন্ধন করতে অনীহা; অবিবাহিত, অনগ্রসর ও নিরক্ষর মেয়েদের ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ কম; মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে ব্যর্থ হওয়া, রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র দূরে হওয়া, আবহাওয়া অনুকূল না থাকা, সামাজিক সংস্কার ও ধর্মীয় অজুহাতে ছবি তুলতে অনীহা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের অসচেতনতা। তখন একাধিক কর্মসূচিও হাতে নিয়েছিল বলেও কমিশন সূত্রে জানা যায়। তারপরও নারীদের ভোটার সংখ্যা বাড়াতে পারেনি কমিশন।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালে দেশে মোট ভোটার ছিল ১০ কোটি ৯৮ লাখ ১৯ হাজার ১১২ জন। সেখানে নারী ভোটার ছিল ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২২ জন। আর পুরুষ ভোটার ছিল ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৮২ হাজার ৫৩০ জন। সেখানে পুরুষের চেয়েও ১১ লাখ নারী ভোটার কম। ২০২১ সালে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ১৭ লাখ ২০ হাজার ৬৬৯। সেখানে নারী ভোটার ছিল ৫ কোটি ৫১ লাখ ২২ হাজার ২২৩ জন। পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ৬৫ লাখ ৯৮ হাজার ৫ জন। ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালে পুরুষ ভোটার ১০ লাখ বৃদ্ধি পেলেও নারী ভোটার বেড়েছে মাত্র ৮ লাখ।

একইভাবে দেশে ২০২৩ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৬৯ হাজার ৭৪১ জন, নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯ জন এবং হিজড়া ভোটার ৮৪৯ জন। সর্বশেষ হালনাগাদের খসড়ায় দেখা যায়, ১২ কোটি ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫০ জন ভোটার; এর মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার ১৩৭ এবং নারী ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৯ এবং ৯২৪ জন হিজড়া ভোটার। এখানেও পুরুষের চেয়েও ২৪ লাখ নারী ভোটার কম। কিন্তু বিবিএসের জনশুমারিতে দেশে পুরুষের চেয়েও নারীর সংখ্যা সাড়ে ১৫ লাখ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জনশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০১ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৫ লাখ ২২ হাজার ৫৯৮ জন। সেখানে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭৭ লাখ ৩১ হাজার ৩২০, আর নারীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ২৭ লাখ ৯১ হাজার ২৭৮ জন। এখানে নারীর চেয়েও ৫০ লাখ বেশি। এই সংখ্যা ২০১১ সালের জনশুমারিতে নারী ও পুরুষের সংখ্যা সমান হয়।

কিন্তু বিবিএসের সর্বশেষ ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ৩ জন। নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন। হিজড়ার সংখ্যা ৮ হাজার ১২৪ জন। ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ২০ বছরে পুরুষের সংখ্যা চেয়েও নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। এখানে পুরুষের চেয়েও সাড়ে ১৫ লাখ বেশি।

জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবি ছাড়া আঙুলের ছাপের মাধ্যমে ভোটার নিবন্ধন নিয়ে আন্দোলন করছে আঞ্জুমান মহিলা পরিষদ। ওই পরিষদ নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনে তাদের দাবির বিষয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। স্মারকলিপি দিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে।

আঞ্জুমান মহিলা পরিষদের শারমিন ইয়াসমিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, ভোটার না হওয়ায় আমরা বেশ কয়েকটি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা কেউ ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছি না। আমাদের অনেক বোনেরা কোথাও চাকরির আবেদন করতে পারছে না। 

তিনি বলেন, আমরা চাই পর্দাশীল নারীদের জন্য ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা পদ্ধতি শিথিল করা হোক। এই জন্য আমরা দুইটা দাবি করেছিলাম। ছবি ছাড়া আঙুলের ছাপের মাধ্যমে ভোটার আইডি কার্ড দেওয়ার জন্য।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ভোটার হতে অনাগ্রহ রয়েছে এমন বিষয় না থাকলেও কিছু কুসংস্কার রয়ে গেছে অনেক এলাকায়। ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে অনেক নারী ভোটার হতে চায় না।

তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে যেসব নারী পর্দা করে তারা ছবি তুলতে চায় না বলেই নারী ভোটারের সংখ্যা কম। নারী ভোটারের সংখ্যা বাড়াতে নির্বাচন কমিশন ছাড়াও জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা সবসময় বলি জাতীয় পরিচয়পত্র যে ভোট দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সেটা না, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ এখন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, জমির দলিল করতে পারে না।

নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে নারী-পুরুষ সকলকে ভোটার হতে আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর