ভোটে উৎসব আনন্দ, আছে অভিযোগও!

বিবিধ, নির্বাচন

এম. এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-24 04:58:56

ঘড়িতে সকাল ৮টা প্রতিদিনই বাজে। তবে প্রতিদিনের সঙ্গে এদিনের প্রায় সবকিছুর সঙ্গে পার্থক্য বেশি স্পষ্ট। কারণ এদিন ভোটের দিন। পাঁচ বছরে একবার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান ভোটাররা। সাদা মোড়কের ব্যালট পেপারে নিজের ইচ্ছায় সিল মোহর আঁকার দিন। বুড়ো আঙ্গুলের নখের ওপর অমোচনীয় কালির দাগ দেখিয়ে বলতে পারার সুখ-‘আমি ভোটার, আমিও ভোট দিয়েছি’!

৩০ ডিসেম্বর (রোববার) সকালের প্রথম সূর্য কিরণই জানিয়ে দিলো আজ নিজের সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। আজ সব প্রজার খানিকক্ষণের জন্য হলেও রাজা হওয়ার দিন। সেই আনন্দেই সকাল ৮টা থেকেই ভোট কেন্দ্রে ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে লাগল। সকালের শুরু থেকে বিকেলে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর ১৬ ও ১৫ আসনের কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখেন এ প্রতিবেদক।

উৎসবের সকাল

মিরপুর-১৬ আসনের বেশির ভাগ ভোট কেন্দ্রে সকাল থেকেই ভোটারদের লম্বা লাইন দেখা গেছে। সকাল ১০টা নাগাদ প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি চোখে পড়ার মতোই ছিল। অনেকে নতুন পোশাক পরে ভোট কেন্দ্রে আসেন। তবে এই আসনের সাংবাদিক আবাসিক এলাকা উচ্চ বিদ্যালয়, পল্লবী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, রিয়াজুল জান্নাত মাদরাসা, রশিদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, কালশী ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুর বাংলা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শহীদ আবু তালেব উচ্চ বিদ্যালয়, এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউট ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লিগের মনোনীত নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস মোল্লার সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব ভোট কেন্দ্রের খানিক দূরে ভোটারদের সহায়তার জন্য বুথ ক্যাম্পের সবগুলোই ছিল নৌকা প্রতীকের। কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে হাতপাখার পোস্টার ঝুলতে দেখা গেলেও অন্য কোনো প্রতীকের বুথ দেখা যায়নি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় রিকশায় চড়ে অনেককে ভোট কেন্দ্রে আসতে দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো।

অনেক নারী ভোটার জানিয়েছেন, সকাল সকাল রান্না করে ভোট দিতে এসেছেন। বেশ কয়েকজন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে এসেছেন। শীতের সকালে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি পুরো পরিবেশকে উৎসবমুখর করে তোলে। সেলফি আনন্দে মেতে ওঠার দৃশ্যও দেখা যায় অনেক কেন্দ্রে।

বাইরে দীর্ঘ লাইন, ভেতরে ধীর গতি

সকাল ১০টার পর এসব কেন্দ্রের প্রায় সব ভোটার অভিযোগ করেন, ‘অনেক সময় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু ভেতরে যেতে পারছি না। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেছে, কিন্তু লাইন যে ছোটই হচ্ছে না! বাইরে এত ভিড়, অথচ মাত্র দু’জন তিনজন ভোটার ভেতরে নেয়া হচ্ছে। বুড়ো মানুষদের অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে।’

মিরপুর-১২ সেকশনের রশিদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এবং মিরপুর সাড়ে ১০ নম্বরে শহীদ আবু তালেব উচ্চ বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের বাইরে সারিবদ্ধভাবে ভোটারদের লম্বা লাইনে দেখা গেলো। সবারই অভিযোগ, বুথের ভেতরে ভোটার প্রবেশ করানো হচ্ছে ধীরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের জন্য অনেকগুলো কক্ষ রয়েছে। তবে ভোট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসা এক ভোটার জানান, ভেতরে তেমন ভিড় নেই, বাইরেই বেশি ভিড়।

সাংবাদিক পরিচয় জেনে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়ানো খায়রুল ইসলাম নামের এক ভোটার অনুরোধের সুরে বললেন, ‘পাশে জান্নাত একাডেমির কেন্দ্রে যান, ওখানে বাইরে প্রচুর ভোটার। কিন্তু বুথে মানুষ কম।’

ভোটার স্লিপ সংকট

ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পথেই আনসার বা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রত্যেক ভোটারকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনার ভোটার স্লিপ কি এনেছেন? যারা এটা দেখাতে পেরেছেন, তারা ভোট কেন্দ্রে সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছেন। যারা ভোটার স্লিপ দেখাতে পারেননি তাদের ভোট কেন্দ্রের দরজা থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

এ আসনের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায় আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এজেন্টদের বুথে। মূলত নৌকা প্রতীক ছাড়া আর কোনো এজেন্টদের বুথ ছিল না। প্রায় সব কেন্দ্রে থাকা নৌকা প্রতীকের একটি মাত্র বুথে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ভোটাররা। সবার কথা, ‘ভাই, আমার ভোটার স্লিপ নাম্বারটা কতো?’

যারা দ্রুত ভোটার স্লিপের খোঁজ পাচ্ছেন তাদের মুখে স্বস্তির হাসি। যারা স্লিপ নম্বর পাননি, তারা মন খারাপ করে হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন।

ভোটাররা অভিযোগ করে জানান, অন্যবার ভোটের আগে বাসায় বাসায় ভোটার স্লিপ দিয়ে যেতো। এবার তো কেউ কোনো স্লিপ পায়নি।

মিরপুর বাংলা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়স্ক আতিক নামের এক ভোটার বলেন, ‘আমি বাসা বদল করেছি। যে বাসার ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল সেখানেও গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানেও আমার ভোটার স্লিপ পাইনি। মনে হয় এবার ভোট দিতে পারবো না।’

কেন্দ্রের বাইরের বুথের টেবিলে গোল হয়ে মোটা ম্যানুয়েল ভোটার তালিকার পাতা উল্টাতে দেখা গেল অনেক ভোটারকে। সকাল থেকে এসব কাজে সহায়তার জন্য যারা ছিলেন তারা ভিড় দেখে তালিকা টেবিলে ফেলে চলে এসেছেন। সেই ভিড়ের মধ্যে যে যেভাবে পারছেন নিজের ভোটার স্লিপ নম্বর খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্তত যাতে ভোট দেয়া যায়!

অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েও এসেছিলেন। তারা কেন্দ্রের বাইরের বুথে ল্যাপটপ নিয়ে বসা সহায়তাকারীর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে। ল্যাপটপ হাতে থাকা বেচারা খানিকক্ষণ পরপরই অসহায় সুরে জানান, সার্ভার স্লো, কাজ হচ্ছে না!

কেন্দ্রের বাইরে ভোটার স্লিপ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হওয়া ভোটারদের সহায়তা করার জন্য তেমন কাউকে ব্যস্ত হতেও দেখা গেল না! লাঞ্চ আওয়ারের কথা বলে ল্যাপটপ গুটিয়ে ফেলার দৃশ্যও চোখে পড়ল! অথচ কে না জানে, একটা ভোট কতো মূল্যবান?

হঠাৎ ককটেল বিস্ফোরণ

দুপুরের দিকে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্ত্বরের পূর্বপাশে আদর্শ স্কুলের সামনে কয়েক সারি পুলিশ ও ডিবির গাড়ি। স্কুলের উত্তর পাশের গেট বন্ধ করা। সেখানেও পুলিশের বাড়তি প্রহরা। এলাকাটা পুরো ফাঁকা। দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা জানান, খানিক আগে এখানে কে বা কারা কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ওয়াকি টকিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশনাও পেলেন তিনি। বিস্ফোরণের শব্দে খানিকটা হুড়োহুড়ি হলেও ভোট গ্রহণে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে কেন্দ্রের বাইরে ভিড় ককটেল বিস্ফোরণের পর অনেক কমে যায়।

একই দৃশ্য দেখা গেল দুপুর দেড়টার দিকে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে। এখানে দু’দফা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তার তাগিদে অনেকে ভোটের লাইন থেকে সরে যান। এ কেন্দ্রে দুপুরের দিকে নিরাপত্তা বাড়াতে র‌্যাবের কর্মকর্তাদের ছুটোছুটি করতে দেখা গেল। দুপুরের খাবার ফেলে রাইফেল হাতে টহলে নামতে হলো তাদের।

রহস্যজনক এই ককটেল বিস্ফোরণ কারা ঘটালো- সেই প্রশ্নের সমাধান কৌতুলের উত্তর বিকেলে ভোট শেষের আলোচনায়ও মিলল না!

তিন কন্যার প্রথম ভোট

মিরপুর গার্লস আইডিয়ালস ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট ভোট কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় রিকশা খুঁজছিলেন তিন তরুণী। এবারই প্রথম ভোট দিয়েছেন তারা। কথা বলার অনুমতি চাইতে, সানন্দে সাড়া। ইতি, তন্বী ও নাজমুন জীবনের প্রথম ভোট দিতে পারার আনন্দে উচ্ছ্বসিত। তারা বলেন, ভালো লাগছে, আমার নাগরিক অধিকার আমি প্রয়োগ করতে পেরেছি। আমি যে চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী সেই পরিমন্ডলে খানিকটা হলেও এই ভোটের মাধ্যমে অবদান রাখতে পেরেছি, এই স্বীকৃতিই অনেক আনন্দের। মনে হচ্ছে নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন আমি আজ ঘটাতে পেরেছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর