আ.লীগের দ্বন্দ্বের সুযোগে ‘লাঙ্গলের দুর্গ’ উদ্ধারে মরিয়া জাপা

বিবিধ, নির্বাচন

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 15:13:02

জাতীয় পার্টি (জাপা) মানে রংপুর। আর রংপুর মানে এরশাদ। লাঙ্গলের দুর্গ বলতেও বুঝায় রংপুরকে। কিন্তু সেই রংপুরেই এখন অস্থিত্ব সংকটে এরশাদের জাতীয় পার্টি। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও এরশাদপ্রীতি কমে যাওয়ায় ভাটা পড়েছে লাঙ্গল দুর্গে। বর্তমানে রংপুর অঞ্চলে অব্যাহত উন্নয়নে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা বেড়েছে সাধারণ মানুষের। ফলে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে জাতীয় পার্টির (জাপা)। বিকল্প শক্তি হিসেবে রংপুরে কদর বেড়েছে আওয়ামী লীগের।

লাঙ্গলের দুর্গে কদর বাড়লেও আওয়ামী লীগের মধ্যে সঙ্গে যোগ হয়েছে দলীয় বিভেদ, কোন্দল আর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। দলটির সেই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে হারানো আসন ফিরে পেতে অংক কষতে শুরু করেছে জাতীয় পার্টি। সযোগে রয়েছে বিএনপিও।

১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনে ভোটের লড়াইয়ে জাতীয় পার্টি এগিয়ে থাকলে হোচট খায় ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে। ১৯৯১ সালে বিভাগের ৩৩টি আসনে- জাতীয় পার্টি ১৭টি, আওয়ামী লীগ ৯টি, বিএনপি একটি। আর অন্যান্য দল পেয়েছিলো ছয়টি আসন।

১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি ২১টি, আওয়ামী লীগ ৮টি, বিএনপি ৩টি আসন পায়। আর অন্যান্য দল পায় একটি আসন। ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের আসন কমে আর বাড়ে বিএনপির। সে সময় বিএনপি ৯টি, আওয়ামী লীগ ৬টি, জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন পায়  এবং অন্যান্য দল ৪টি আসন পেয়েছিলো।

২০০৮ সালে বিএনপির ঘরে একটি আসন না জুটলেও বাড়ে আওয়ামী লীগের। ওই বছর আওয়ামী লীগ ১৯টি, জাতীয় পার্টি ১৩টি এবং অন্যান্য দল একটি আসন পায়। আর সর্বশেষ ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। সে সময় আওয়ামী লীগের ঝুঁড়িতে বিভাগের ২২টি আসন চলে যায়। আর জাতীয় পার্টি পায় সাতটি। আর অন্যান্য দল পায় ৪টি আসন।

এবার রংপুর জেলার সংসদীয় ৬টি আসনের মধ্যে বর্তমানে রংপুর-১ ও রংপুর-৩ আসনে এরশাদের জাপা ছাড়া ৪টিতে আওয়ামী লীগের অধিপত্য। একারণে রংপুরে আবারো আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা বিজয় নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা ও গণসংযোগ চালাচ্ছেন। বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ নিয়ে গঠিত রংপুর-২ আসনে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রংপুর-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক। রাজনৈতিক ডামাডলে গত নির্বাচনে এরশাদের নাটকীয় সিদ্ধান্তে এই আসনটি হারিয়েছে জাতীয় পার্টি। এবার সেই হারানো আসন ফিরে চায় তার দলটি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে এবারও মনোনয়নের প্রত্যাশায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বর্তমান এমপি ডিউক চৌধুরী।

ডিউকের মত নৌকার টিকেট নিয়ে নির্বাচন করতে চান সাবেক প্রতিমন্ত্রী আনিছুল হক চৌধুরীর ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান টুটুল চৌধুরী ও শান্ত চৌধুরী। এছাড়া প্রচার প্রচারণায় মাঠে রয়েছেন পৌর মেয়র উত্তম কুমার সাহা ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. এম শাহ নওয়াজ, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু

একদিকে আনিছুল হক চৌধুরীর পরিবারের বিরোধ। সঙ্গে মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের প্রকাশ্য বিভক্তি- সব মিলে  এই আসনে বেসামাল আওয়ামী লীগ।

বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য এসব প্রার্থীদের মতবিরোধ, পাল্টাপাল্টি অবস্থান, দুর্নীতি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে- এ আসনে এখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই।

এমপি ডিউক চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগের চেয়ে দলীয় নেতাদের অভিযোগের পাল্লাই ভারি। এনিয়ে মাথা নেই এমপি ডিউকের। বরং কেউ দুর্নীতির সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ দিতে পারলে দল থেকে পদত্যাগ করবেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন দলের নেতা-কর্মীদের।

ডিউট চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগে কোনো বিভেদ-দ্বন্দ্ব নেই। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই দল অন্য নেতারাও নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করতেই পারেন। এটাতো দলে বিভক্তি নয়। বরং তফসিল ঘোষণা হলে দলের পক্ষে থেকে যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে, তার পক্ষেই সবাই কাজ করবে।

এ সময় বর্তমান এই এমপি বলেন, আমিতো ঢাকায় পড়ে থাকি না। এলাকার মানুষের পাশেই আছি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নিচ্ছি। এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা সবাই আমার পক্ষে। 

বদরগঞ্জ পৌর এলাকার নারী অধিকার কর্মী আফরোজা সরকার বলেন, এমপি হিসেবে ডিউক চৌধুরী ব্যতিক্রম। তিনি সকালে বাসা থেকে বের হয়ে আগে সাধারণ মানুষের দেখা করেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে নতুবা হোটেলে বসে বসে মানুষের খোঁজখবর নেন। দিন-রাত পথেঘাটে সবার সাথে দেখা হলে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দেন। মানুষের সাথে যেমন সংখ্যতা তৈরি করেছেন। তেমনি এলাকার উন্নয়নও করেছেন তিনি।

তারাগঞ্জ বাজার এলাকার তরুণ ভোটার মুন্না মিয়া বলেন, ভোট এলে তো সবাই পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ভোট শেষেও তো কাউকে আর দেখা যায় না। গত নির্বাচনে ভোটে দিতে পারি নি কিন্তু এমপি পেয়েছি। এবার ভোট দিতে চাই। যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে চাই। এ সময় তিনি জানান, বদরগঞ্জে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ভোট হলে এবার জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

অন্যদিকে বদরগঞ্জ নাগেরহাট এলাকার বাসিন্দা সাংবাদিক আবদুস সালাম সরকার জানান, মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগে কোন্দল রয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টিতেও রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। এই সুযোগে ভিতরে ভিতরে হারানো আসন ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জাতীয় পার্টি। ক্ষমতাসীনদের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে এগিয়ে রয়েছে বিএনপিও।

জাতীয় পার্টির চরম দুর্বলতা আর আওয়ামী লীগের বিভাজনে সুযোগ নিতে চায় বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে এগিয়েও রয়েছে দলটি। এই আসনে প্রতিনিধিত্ব করার রেকর্ডও রয়েছে বিএনপির। এ কারণে তাদের সম্ভাবনা বেড়েছে। বিএনপি থেকে এখানে রয়েছে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী।

জামায়াতের একমাত্র প্রার্থী দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি। তাই তার নির্বাচন করার কোনও সম্ভাবনা নেই বলে। এ কারণে জামায়াতের একটি বড় অঙ্কের ভোট বিএনপিতে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

বিএনপির উপজেলা সভাপতি ও সাবেক এমপি অধ্যাপক পরিতোষ চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শাহান, বদরগঞ্জ পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কমল লোহানী এবং জেলা বিএনপির সদস্য সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকারও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হতে চান আসাদুজ্জামান চৌধুরী সাবলু, অ্যাডভোকেট মোকাম্মেল হোসেন চৌধুরী ও সাবেক এমপি আনিসুল ইসলাম মন্ডল। তবে জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ সাবলু চৌধুরীকে প্রাথমিক সমর্থন দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এরেই মধ্যে মাঠে ঘাটে গণসংযোগও শুরু করেছেন তিনি।

জাপার সম্ভাব্য এই প্রার্থী বলেন, বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ এরশাদের দুর্গ ছিলো, এখনো রয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে জনগণের রায়ে এরশাদ মনোনীত প্রার্থীই নির্বাচিত হবেন। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মহাজোটগত নির্বাচন করলেও এই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এছাড়াও জাসদের (আম্বিয়া-প্রধান) আবদুস সাত্তার, জাসদের (ইনু) কুমারেশ রায়, জেলা নাগরিক ঐক্যের সদস্য জয়চন্দ্রসহ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রার্থীও  এই আসনের ভোট যুদ্ধে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর