অভিষ্ঠ লক্ষ্যে বরিশাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

বিদ্যুৎ-জ্বালানী, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, বরগুনা থেকে | 2023-08-28 14:11:16

প্রাইভেট খাতের বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করেছে সরকার। এর মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট প্রকল্পটির দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময় ২০২২ সালেই উৎপাদনে আসার বিষয়ে দৃঢ় সংকল্পের কথা জানিয়েছে।

বর্তমান সরকারের হাত ধরে বিদ্যুৎ খাতের অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু খুবই হতাশাজনক চিত্র সাশ্রয়ী হিসেবে বিবেচিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে। দেশীয় একাধিক খ্যাতনামা কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হলেও এখনো পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা হাক-ডাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে বরিশাল পাওয়ার কোম্পানির বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। কোম্পানিটি ২০১৭ সালের এপ্রিলে চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে। অল্প সময়ের মধ্যে ভূমি উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য জমির প্রয়োজন হবে দেড়শ’ একরের মতো। আমরা সেকেন্ড ফেজ মাথায় রেখেই এগিয়ে যাচ্ছি। সেকেন্ড ফেজ অর্থাৎ দ্বিতীয় ইউনিট করতে হলে আড়াইশ’ একরের মতো জমির প্রয়োজন পড়বে। প্রায় দুইশ’ একর জমির মাটি ভরাট শেষ হয়েছে। প্রথম ইউনিটের জন্য যে জমির প্রয়োজন, সেসব জমির উন্নয়ন শেষ।

আর যদি আড়াইশ’ একর ধরি, তাহলে ৭০ শতাংশ জমি ভরাট শেষ হয়েছে। এখন সাইট অফিস নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। আগামী মাসে ডরমেটরি নির্মাণসহ অন্যান্য সিভিল ওয়ার্ক শুরু হবে। তখন এক সঙ্গে মূল পাওয়ার প্লান্টের কাজও শুরু হবে বলে জানান আনোয়ার হোসেন।

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের জটিল বিষয় হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ ও বাসিন্দাদের পুনর্বাসন। অন্যান্য জায়গায় পুনর্বাসন নিয়ে জটিলতা থাকলেও এখানে তেমনটি ছিল না। মাত্র ১৩৯টি বাস্তুহারা পরিবার ওই প্রকল্প এলাকায় অস্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। তাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে জমি কিনে দেওয়া হয়েছে। নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে বলে জানিয়েছে পুনর্বাসিত আইয়ুব আলীসহ অন্যরা।

দ্রুত এগিয়ে চলেছে  বরিশাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

 

প্রকল্প এলাকা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে শোভা পাচ্ছে এক সময়ের এসব ভাসমান লোকজনের বাসস্থান।

সরেজমিন পরিদর্শন কালে দেখা গেছে, চারদিকে শত শত মেশিনারিজ বিরামহীনভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি খনন করা ও সমান করার কাজ চলছে। ক্রেন দিয়ে ভারি মালামাল ও যন্ত্রপাতি ওঠানো-নামানো চলছে। বুলডোজার ও ভেকু দিয়ে চলছে বিরামহীনভাবে মাটি লেভেলিংয়ের কাজ। রোলার দিয়ে হচ্ছে মাটি শক্ত করার কাজ। ভরাটকৃত জমিতে কমপ্যাক্ট নিশ্চিত করার জন্য হ্যামার ব্যবহার করে পানি শুষে নেওয়া হচ্ছে। পশ্চিম দিকে পায়রা নদীর কোল ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী শেড।

প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চীনের ‘পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড’ ও বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আইসোটেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড’। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা (৫৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে ভেন্ডর। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দর ধরা হয়েছে ৬.৭৭ টাকা (প্রতিটন কয়লার দর ১২০ ডলার হিসেবে)। কয়লার দাম কম থাকলে সেই অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম কমে যাবে।

আইসোটেক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মঈনুল আলম বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ কাজ ৪৫ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ এবং স্থানীয় প্রশাসন প্রত্যক্ষভাবে সহোযেগিতা করে যাচ্ছে। এজন্য আমরা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’

‘প্রকল্পটি সফলভাবে সমাপ্ত করতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণও সাহায্য করছে। সবার সাহায্য সহযোগিতা না পেলে এত বড় কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয়। আমরা আশা করছি, সবার সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবো,’ যোগ করেন মঈনুল আলম।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পার্টনার পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান। তারা ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে দক্ষতার সঙ্গে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। তারা বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।’

দ্রুত এগিয়ে চলেছে  বরিশাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

 

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে সাড়ে তিন হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া এ অঞ্চলের জনগণের কথা চিন্তা করে প্রকল্প এলাকায় স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। যেহেতু ওই এলাকার মিঠা পানির সঙ্কট রয়েছে, তাই গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয়দের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে বরিশাল পাওয়ার কোম্পানি।

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প। এটি হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে যাবে বলে আমি মনে করি। আমরা চাই, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হোক। প্রকল্পের লোকজন আমাদের নিশ্চিত করেছেন, পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ তারা করবেন না। আমরাও এ বিষয়ে সজাগ রয়েছি।’

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর