দেউলিয়ার পথে চট্টগ্রামের মোস্তফা গ্রুপ, চেয়ারম্যান জেলে, পরিচালকরা পলাতক

ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 12:49:20

দেশের এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান মোস্তফা গ্রুপ। ১৯৫২ সালে ভোগ্যপণ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক যাত্রা। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মোস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে গ্রুপের প্রতিষ্ঠা। সময়ের পরিবর্তনের তার হাত ধরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন খাতে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে তোলেন।

যুগের পর যুগ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় নেতৃত্ব দেওয়া শিল্পগ্রুপটি সম্প্রতি ঋণে জর্জরিত হয়ে ডুবতে বসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে শিল্প গ্রুপটির বিভিন্ন ব্যবসার খাতও। এমনকি বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসাও নেই গ্রুপটি। ঋণের বোঝায় টিকে থাকা ব্যবসার অন্যখাতগুলোও ধুঁকছে।

২০০৬ সালে মোস্তফা রহমানের মৃত্যুর পর পরবর্তী প্রজন্মের অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় গ্রুপের পতনের শুরু বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। গ্রুপের দায়িত্ব নেওয়া তার সাত সন্তান ব্যবসার পরিধি বাড়াতে ঋণ নেওয়া দিকে ঝুঁকে পড়েন। তারা ভোগ্যপণ্য ও ভোজ্যতেল আমদানি, শিপব্রেকিং, পেপার মিলসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নেন। স্বল্পমেয়াদি ঋণের এসব অর্থ বিনিয়োগ করেন দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ গড়ার কাজে। কিন্তু সুদক্ষ ও সৎ ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপটির অবস্থা এখন নাজুক ।

অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সুনাম থাকায় ব্যাংকগুলোও শিল্প গ্রুপটির চাহিদা মতো ঋণ প্রদান করে। সেই ঋণের বোঝায় মোস্তফা রহমানের কষ্টে গড়া শিল্প গ্রুপটি আজকে দেউলিয়ার পথে। খেলাপি ঋণের জন্য পরিচালকদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা চারটি মামলায় গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজেতুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি পরিচালকদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেও রয়েছে পরোয়ানা।

বাবার মৃত্যুর এক বছর পরেই অর্থাৎ ২০০৭ সালে লোকসানের মুখে পড়ে গ্রুপটি। এই লোকসান চলতে থাকে টানা ২০১৩ সাল পর্যন্ত। জানা গেছে, গ্রুপটির খেলাপি হওয়া ঋণগুলোর বেশির ভাগই নেয়া হয়েছে ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। বর্তমানে মোস্তফা গ্রুপের কাছে ব্যাংকসহ ৩১টিরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে মোস্তফা গ্রুপের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ৩০০ কোটি টাকা। এছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ১৩৫ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার সাড়ে ৫৬ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার সাড়ে ৩৫ কোটি, উত্তরা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার সাড়ে ৩৩ কোটি, এনসিসি ব্যাংক আন্দরকিল্লা শাখার সাড়ে ৩১ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ২১ কোটি, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাড়ে ১৮ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের সাড়ে ১৭ কোটি, ইউসিবিএল জুবিলী রোড শাখার ১৬ কোটি ও ব্যাংক আল ফালাহ আগ্রাবাদ শাখার সাড়ে ৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

উপরের প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও মোস্তফা গ্রুপের কাছে সাউথইস্ট ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ২০০ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ৮০ কোটি, পূবালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৬৫ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট আগ্রাবাদ শাখার ৪০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ৪০ কোটি, রূপালী ব্যাংক লালদীঘি শাখার ২৮ কোটি, মাইডাস ফিন্যান্স লিমিটেডের ২২ কোটি টাকাসহ ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা, ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংকের বড় অংকের পাওনা রয়েছে।

মোস্তফা গ্রুপ সবচেয়ে বেশি অংকের ঋণ নিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে। এই শাখার ব্যবস্থাপক এএসএম হেলাল উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সুনামের কারণে বড় অংকের ঋণ দেওয়া হয়েছিলো মোস্তফা গ্রুপকে। গ্রুপটির কাছে পাওনা ৩০০ কোটি টাকা আদায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে ব্যাংকটি। ঋণ পরিশোধে কোনো আগ্রহ নেই শিল্প গ্রুপটির কর্ণধারদের।

ঋণে জর্জরিত হয়ে মোস্তফা গ্রুপের ব্যবসা দিনে দিনে সংকোচিত হয়ে আসছে। শিপব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের দীর্ঘদিনের সভাপতি হেফাজতুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মোস্তফা গ্রুপ শিপব্রেকিং খাতের ব্যবসাও বন্ধ করে দিয়েছে। ভোজ্যতেলের ব্যবসা বন্ধ করে ট্যাংক টার্মিনাল বিক্রি করে দিয়েছে গ্রুপটি। চা-বাগান, রাবারবাগান, আমবাগান, কাগজ, মত্স্য (চিংড়ি), স্টিল, পরিবহন, শিপিং, সিকিউরিটিজ ও পোশাক খাতের বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে গ্রুপটির।

গ্রুপটির খেলাপি হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মোস্তফা ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, মোস্তফা করপোরেশন, এমএম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, এমএম করপোরেশন, মেসার্স মোস্তফা এন্টারপ্রাইজ, মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স, মোস্তফা শ্রিম্প প্রডাক্টস, মোস্তফা গ্যালভানাইজিং প্লান্ট।

শিল্প গ্রুপটির এমন দুর্দশা নিয়ে মোস্তফা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন বলেন, আমাদের প্রধান ব্যবসা ছিল ভোগ্যপণ্য ও শিপব্রেকিং খাতে।  কিন্তু ১/১-এর সময় থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে।  ওই সময়ে  ঋণের উচ্চ সুদ আমাদের খেলাপি বানিয়ে দেয়।

নিজেদের পরিস্থিতির শিকার উল্লেখ করে জহির উদ্দিন বলেন, আমারা ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছি। ব্যাংক থেকে নতুন অর্থায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।  তবে বর্তমানে ব্যাংকগুলো আমাদের বিপদের সময় অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের অভাবে সব ধরনের সক্ষমতা থাকার পরও আমরা প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে পারছি না।

এ সময় তিনি  মোস্তফা গ্রুপের মতো দেশের পুরনো ও রুগ্ণ শিল্প গ্রুপগুলোকে সচল রাখতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্ববান জানান।

দেশের ব্যাবসা খাতের নেতৃত্ব দিয়ে আসা মোস্তফা গ্রুপের পতনের পিছনে বহু কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ পাওনাদার ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তারা। তারা জানান, ব্যবসায় করপোরেট সংস্কৃতির উন্নয়ন না ঘটানো, গতানুগতিক পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা। এবং কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠানের লাভের চেয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বাস্তবায়নে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এসব কারণেই আজকে প্রতিষ্ঠানটির করুণ দশা

প্রসঙ্গত, মোস্তাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন ধরে গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন তার বড় ছেলে হেফাজতুর রহমান। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন জহির উদ্দিন। তাদের ভাই কফিল উদ্দিন গ্রুপটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, শফিক উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান ও কামাল উদ্দিনসহ তিনজন পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর