বন বিভাগের জমি দখল করায় জিপিএইচ ইস্পাতের বিরুদ্ধে মামলা

ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-12-22 21:10:44

সীতাকুন্ড (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: নতুন কারখানা স্থাপনে জোরপূর্বক অন্যের ঘর-বাড়ি দখলের চেষ্টা করছে জিপিএইচ ইস্পাত। দরিদ্র পরিবারগুলো বাড়ি ছাড়তে রাজি না হওয়ায় তাদের পানি নেমে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু অন্যের জমি দখল নয়, বন বিভাগের জমিও দখলের অভিযোগ রয়েছে জিপিএইচ ইস্পাতের বিরুদ্ধে। এর জন্য জিপিএইচ ইস্পাতের বিরুদ্ধে সীতাকুন্ড থানায় মামলা করেছে বন বিভাগ বলে গেছে।

 

অন্যদিকে কারখানাটির পূর্বদিক ঘেঁষে অবস্থিত ত্রিপুরা পল্লীর অন্যতম পানির উৎস পাহাড়ের ঝিরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ঝিরির উপর নির্ভরশীল কুমিরা বনাঞ্চলও। ঝিরিটি বন্ধ করে দেওয়ায় বনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে চট্টগ্রাম বন বিভাগ।

জিপিএইচ ইস্পাত যাদের বাড়ি দখল করে নিতে চাচ্ছে তাদেরই একজন মসজিদ্দা গ্রামের বৃদ্ধা মতিলাল দাশ (পিতা: বৃন্দাবন দাশ)। এলাকাটিতে শতাধিক দরিদ্র পরিবারের বসবাস রয়েছে। গ্রামটির পশ্চিম দিকে অবস্থিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। আর সড়কের পাশের একটি নালা গিয়ে মিশেছে সাগরে। এই নালা দিয়ে মতিলালদের পাড়ার পানি নেমে যেত সাগরে।

কিন্তু সেই পানি নেমে যাওয়ার নালায় জিপিএইচ তাদের কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকটা টিলার মতো করে রেখেছে। এতে একটু বৃষ্টি হলেই বাড়িগুলোতে পানি জমে যাচ্ছে।

গত ৯ মে সরেজমিন গেলে মতিলালের উঠানে অনেক কাদাপানি দেখা গেছে। অনেকটা নর্দমার মতো পরিণত হয়েছে। ঠিক গ্রামের কুয়া কিংবা নলকূপের পানি নেমে যাওয়ার কাঁচা ড্রেনে যেভাবে কাদাপানি জমে থাকে তেমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তখন কয়েকটি হাঁসও আপন মনে বিচরণ করছিলো সেখানে।

মতিলাল দাশ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ত্রিশ বছর ধরে এখানে বসবাস করছি। নিজের নামে বন্দোবস্ত করে নেওয়া জমি। আমাদের নামে খাজনা খারিজ সবই রয়েছে। কিন্তু জোর করে আমাদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছে। পানি নেমে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। দেখেন কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হয়েছিলো সেই পানি এখন উঠানে জমে কি অবস্থা হয়েছে।

চরম অসহায় লাগছে, কোথাও গিয়ে সহায়তা পাচ্ছি না। তারা টাকার বস্তা খুলে দিয়েছে। কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। আমাদের দ্রুত বাড়ি ছাড়তে বলা হয়েছে। না হলে ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

মতিলালের ঘরের উত্তর দিকে একটি বিশাল ঢিবি করা হয়েছে রডের বর্জ্য দিয়ে। দেখতে অনেকটা ভাটায় ইট তৈরির জন্য রাখা মাটির স্তুপের মতো। বিপরীত দিক থেকে মতিলালদের ঘর আর দৃশ্যমান নয়। ঢাকা পড়েছে বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপে।

গ্রামবাসীর অভিযোগ, তাদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য এই ঢিবি করে হুমকি দেখানো হচ্ছে। না হলে টিলার মতো এমন ঢিবি করার কোনই প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না তারা। মতিলাল দাশও মনে করে তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য এই স্তুপ করা হয়েছে।

জিপিএইচ ইস্পাত কর্তৃপক্ষের হুমকির কারণে, এখানকার অনেক ভাড়াটিয়া ঘর ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু মতিলালের মতো কিছু বাসিন্দা রয়েছে যাদের আর অন্যত্র যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা শত প্রতিকূলতা শর্তেও মাটি আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। কিন্তু কতদিন থাকতে পারবেন সে নিয়ে রয়েছে সংশয়ে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’র (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বার্তা২৪.কম’কে বলেন, স্টিল রি-রোলিং মিল একটি রেড ক্যাটাগরির কারখানা। তারা বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলতে পারেন না। তাদের নিজেদের ইটিপি থাকা উচিত। এসব বর্জ্য বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে, আবার বৃষ্টির সঙ্গে নদীতে দিয়ে পানি দূষণ করে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

জিপিএইচ কারখানার পশ্চিমে যখন এমন অত্যাচার চলছে। পূর্বদিকে পাহাড়ের কোল ঘেষা ত্রিপুরা পল্লীর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে জিপিএইচ। তাদের মিঠা পানির অন্যতম উৎস পাহাড়ের ঝিরিতে রাতারাতি বাঁধ নির্মাণ করে পানি আটকে দিয়েছে। যে কারণে সহজলভ্য পানির উৎস হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে ত্রিপুরা পল্লীর লোকজন। কিন্তু প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম (উত্তর) বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী বার্তা২৪.কমকে বলেন, জিপিএইচ ইস্পাতের বিরুদ্ধে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সীতাকুন্ড থানায় মামলা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে বলে দেওয়া হয়েছে কাজ বন্ধ রাখার জন্য।

সীতাকুন্ড উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. কামরুজ্জামান বার্তা২৪.কমকে বলেন, জিপিএইচ ইস্পাতের বিষয়ে একটি গোপন তদন্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে উঠে আসবে পরিবেশসহ অন্যান্য ক্ষতির বিষয়টি। তদন্তে কি পাওয়া গেছে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে ক্ষতিকারক কিছু পেলে ছাড় দেওয়া হবে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) সৈয়দ নাজমুল আহসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি জানি একটি কোম্পানি এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে বিদেশে রফতানি করে। এই বর্জ্যে কি ধরণের জীবানু থাকে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। দেখে বলতে হবে।

জিপিএইচ ইস্পাতের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নন বলে এড়িয়ে গেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হলে পরে জানাবেন বলে এড়িয়ে যান।

জিপিএইচ ইস্পাতের একমাত্র কারখানাটি রয়েছে সীতাকুন্ডের ওই এলাকায়। নতুন করে তা বিশাল এলাকা জুড়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এতে ত্রিপুরা থেকে জেলে কামার কারো বসতি রক্ষা পাচ্ছে না। নতুন অটোমেটেড কারখানাটির রড উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১০ লাখ মেট্রিক টনের মতো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর