ভাতিজার নিয়োগ কাল হলো বিমানের এমডি মোসাদ্দিকের

ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-23 04:23:07

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান হলেও দিন শেষে এটি একটি বাণিজ্যিক এয়ারলাইন্স। আর তাই লাভ-লোকসানের হিসাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় সিংহভাগই এসে পড়ে এয়ারলাইন্সটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) উপর।

ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে সদ্য বিদায়ী বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোসাদ্দিক আহমেদের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। আর এসব অভিযোগ এনে গত ৩০ এপ্রিল তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিমানের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বিমানের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আশরাফুল আলম ও ডিজিএম শফিকুল ইসলামকে ওএসডি করা হয়েছে। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিমানের কার্গো পরিবহনে অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মোসাদ্দিক আহমেদ কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেননি।

এই কারণে এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিনামূল্যের টিকেট বিক্রি করে ১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি যুক্তরাজ্যে কান্ট্রি ম্যানেজার থাকাকালীন লন্ডন থেকে দুই হাজার ৪৭২টি বিনা মূল্যের টিকেট ইস্যু করা হয়। যার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিজনেস ক্লাসের টিকিট ছিল এক হাজার ১৩৬টি এবং ইকোনমি ক্লাসের ছিল এক হাজার ৩৩৬টি। 

শফিকুল ইসলাম চার বছর বিমানের যুক্তরাজ্যের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে সম্প্রতি ঢাকায় বদলি হন।

মিশর থেকে লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজে এরই মধ্যে এয়ারলাইন্সকে ৩০০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। বিষয়টি শুধু এখানেই থেমে নেই। অসম চুক্তি করে আনা এয়ারলাইন্স দুটিকে ফেরত পাঠাতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স পড়েছে নতুন সমস্যায়। চুক্তি অনুযায়ী উড়োজাহাজ দুটি যে অবস্থায় আনার কথা ছিল সেই অবস্থায় ফেরত দিতে হবে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বিমানের প্রধান কার্যালয়ে পরিদর্শনে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ সময় তিনি বিমানের তৎকালীন এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ ও বিমান সচিব মহিবুল হককে এক হাত নেন।

মাহবুব আলী মন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশংসিত ছিলেন মোসাদ্দিক আহমেদ। এরপর মাহবুব আলী বিমানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে তার থলের বিড়াল। এরই মধ্যে সব নিয়মনীতির ব্যত্যয় করে পাইলট হিসেবে নিয়োগ দেন ভাতিজা মোক্তাদিরকে। আর এই অনিয়মই কাল হলো তার জন্য।

ভাতিজাকে নিয়োগ দিতে মোসাদ্দিক ১৩ ধরণের অনিয়ম করেন। ভাতিজাকে সুযোগ দিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সংশোধনী এনে শিক্ষাগত যোগ্যতা হ্রাস করা, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিমানের পরিচালনা পর্ষদকে উপেক্ষা করা, নিয়োগ পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা রাখা (কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার নজির নেই), বিমানের অপারেশনাল ম্যানুয়েল পার্ট অনুসারে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৭৫ নম্বরের লিখিত এবং ২৫ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার বিধান থাকলেও তা না মানা, ৩০ জন প্রার্থীর ডিগ্রি এইচএসসি (বিজ্ঞান) সমমান কিনা, তা যাচাই বাছাই না করেই গ্রহণের সুপারিশ করা, ক্যাডেট পাইলটের জন্য সম্পূর্ণ লিখিত পরীক্ষায় পাস করা ৭৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ২২ জনকে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো হয়।

এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের অপারেশনাল ম্যানুয়েল অনুসারে ক্যাডেট পাইলট পদের জন্য বয়স ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর রাখা হয়। এখানেও মোসাদ্দিক বয়সসীমা ৪০ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে অনিয়ম করেন।

নানা অনিয়ম-দুর্নীতির পরেও দুই দফায় মোসাদ্দিক আহমদেকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার সময়কালে বিমান লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে না পারেনি। 

তাকে প্রথম দফায় এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ২০১৬ সালের জুনে। এই নিয়োগ ছিল দুই বছরের জন্য। পরবর্তীতে আবার এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এই সময়কালে এমডি পদে কোনো ধরণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। পরবর্তীতে তার পূর্ণকালীন এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া নিয়ে বিমানের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা ছিল।

এমনকি পেশাগত জীবনে দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে খ্যাতিও ছিল না মোসাদ্দিকের। বলা হতো, তিনি শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের ভালোভাবে ম্যানেজ করতে পারতেন। আর এ কারণেই তিনি দুই দফায় নিয়োগ পান। তবে শেষ পর্যন্ত ভাতিজার নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের কারণে এয়ারলাইন্স থেকে অপমানজনকভাবে বিদায় নিলেন মোসাদ্দিক আহমেদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর