খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা চূড়ান্ত, থাকছে নবায়নের সুযোগ

ব্যাংক বীমা, অর্থনীতি

আসিফ শওকত কল্লোল, স্পেশাল করেসপন্ডেট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-22 04:43:34

খেলাপিদের বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনগর্ঠনের নতুন নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। অচিরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এটির প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এর আওতায় শর্ত সাপেক্ষে সব ধরনের খেলাপিরাই তাদের ঋণ নবায়ন করার সুযোগ পাবেন। তবে নীতিমালার আওতায় ঘোষিত সব ধরনের সুবিধা সব গ্রাহক সমানভাবে পাবেন না।

গ্রাহকের ব্যবসার ধরন, ঋণের প্রকৃতি, গ্রাহকের নগদ টাকার প্রবাহ, লেনদেন পরিস্থিতি, সম্পদের পরিমাণ, ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করবে গ্রাহকের প্রাপ্ত সুবিধা। এসব বিবেচনায় নিয়ে কেস টু কেস ভিত্তিতে ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করবে বাণিজ্যিক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরই সুবিধা কার্যকর হবে। এসব বিধি বিধান রেখেই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

নীতিমালাটি চূড়ান্ত করতে গত সপ্তাহে এ বিষয়ে গঠিত তিনটি কমিটি একাধিক বৈঠক করেছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মতভেদগুলো কমিয়ে এনেছে। এর ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমদ জামালের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির চারজন সদস্য একটি অনির্ধারিত বৈঠকে বসে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করেছেন। এর আগে তারা নীতিমালার খসড়াটি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালকে দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়ার পরই অর্থমন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ দু’জন কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংককে আসেন। তারা ডেপুটি গভর্নর আহমদ জামালের কক্ষে বৈঠকে বসেন। এর এক পর্যায়ে ওই ডেপুটি গভর্নর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এর মাধ্যমেই নীতিমালাটি চূড়ান্ত হয়েছে।

সূত্র জানায়, নীতিমালার অনেক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি ছিল। এগুলো তারা লিখিতভাবে এবং বিভিন্ন সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। তারপরও তাদের সব আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি। তবে বেশ কিছু বিষয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তির ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়েছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশেষ ছাড় দিয়ে বারবার খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দিলে খেলাপি সংস্কৃতি উৎসাহিত হবে। এতে ভালো গ্রাহকরা নিরুৎসাহিত হবেন। ব্যাংকিং খাতও খেলাপি সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারবে না।

সূত্র জানায়, নতুন নীতিমালার আওতায় বড়, মাঝারি, ছোট, কৃষি ঋণ গ্রহীতা ও নারী উদ্যোক্তারা ব্যবসার ধরন বুঝে সুবিধা পাবেন। নীতিমালার সব সুবিধা সার্বজনীন হবে না। কেস টু কেস ভিত্তিতে সুবিধা নির্ধারিত হবে। ট্রেডিং, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড (এক বছর কোন কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না) পাবেন। বড় উদ্যোক্তারা পাবেন ২ বছরের গ্রেস পিরিয়ড। ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হবে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের বা তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ভিত্তিতে। সরকারি ব্যাংকগুলো শর্ত সাপেক্ষে সুদ হার কস্ট অব ফান্ডের চেয়েও কম নিতে পারবে। সুদ হিসাব করা হবে সরল সুদে। অর্থাৎ সুদের উপর কোনো সুদ আরোপ করা যাবে না। গ্রাহকের কাছ থেকে মূল ঋণের সঙ্গে সুদও আনুপাতিক হারে আদায় করা হবে।

সরকারি ব্যাংকের এক চেয়ারম্যান নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের কারণে অনেকে আটকে রয়েছেন। ব্যবসা করতে পারছেন না। তাদেরকে ব্যবসা করে ঋণ শোধের সুযোগ দিতেই এই উদ্যোগ। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাংক বা উদ্যোক্তা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হয়েছে।

নীতিমালায় বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক হিসাব আমলে নিয়ে এ সুবিধা নেওয়ার জন্য গ্রাহকরা আবেদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে ওই তারিখে ঋণের স্থিতির ১ শতাংশ বা ১ কোটি টাকার যেটি কম তা এককালীন নগদ জমা বা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে আবেদন করতে হবে। ঋণের পরিমাণ ও গ্রাহকের ব্যবসার ধরন ভেদে মাসিক বা ত্রৈমাসিকভিত্তিতে ঋণের কিস্তি নির্ধারিত হবে। কৃষিঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে কোনো ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে না। এগুলো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন করা যাবে।

নীতিমালা অনুযায়ী সিন্ডেকেট ঋণ (একাধিক ব্যাংকের সমন্বয়ে দেয়া) নবায়নে লিড ব্যাংকের কাছে আবেদন করতে হবে। লিড ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

কস্ট অব ফান্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে ঋণের সুদ মওকুফ করা যাবে। এরপর যদি অবশিষ্ট সুদ থাকে সেগুলো সুদবিহীন আলাদা ব্লক হিসাবে রেখে দুই বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরের ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। মূল ঋণের পরিশোধ সূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুদ পরিশোধ সূচি ঠিক করা হবে।

উল্লেখ্য, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখতকে প্রধান করে ছয় সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে ১০ সদস্যের অপর একটি কমিটি পর্যালোচনা করে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়য়ের উচ্চপদ্স্থ কর্মকর্তারা রয়েছেন। এছাড়া ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট আরো একটি কমিটি বিষয়ে কাজ করেছে।

এর আগে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের রাজনৈতিক আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্থ ঋণ খেলাপি উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে তিনটি নীতিমালা জারি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫০০ কোটি ও এর চেয়ে বেশি অংকের ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন করতে ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারিতে একটি সার্কুলার এবং ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের খেলাপি ঋণ নবায়নে আরো একটি সার্কুলার জারি করা হয় একই বছরের ২৩ ফের্রুয়ারি। ভাল উদ্যোক্তাদের ১০ শতাংশ সুদ রিবেট সুবিধা দিয়ে তৃতীয় সার্কুলারটি জারি করা হয় একই বছরের ১৯ মার্চ।

আরও পড়ুন: ঋণ খেলাপিদের আরো সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব!

এ সম্পর্কিত আরও খবর