জালিয়াতির নিয়োগে বিপিসিতে এটিএম সেলিম ও মণি লাল

, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 17:16:08

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এটিএম সেলিম ও মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণি লাল দাশের নিয়োগ জালিয়াতির প্রশ্নে নিরব কর্তারা। অনেক দিন ধরেই বিষয়টি আলোচিত হলেও ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিপিসির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, যেহেতু বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এর সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত। পত্রিকায় নিউজ হওয়ার পর জালিয়াতির তথ্য মুছে ফেলতে ফাইলগুলোই সম্ভবত গায়েব করে ফেলা হয়েছে। এখন আর এগুলোর হদিস মিলছে না। সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনও এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই বিপিসিতে চাকরি পান এটিএম সেলিম ও মণি লাল দাশ। বিপিসি সূত্র জানিয়েছে, ৪টি পদের বিপরীতে ১৯৯৬ সালে ….দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নিয়োগ বোর্ড সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে হিসাব বিভাগে কাজী শহীদুর রহমান, বাণিজ্য বিভাগে আবুল কালাম আজাদ, এমআইএস বিভাগে মোঃ সোয়েব আহমেদ ও পরিকল্পনা বিভাগে মোঃ মনিরুল ইসলাম নিয়োগ দেয়। নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাসের মাথায় সোয়েব আহমেদ চাকরি ছেড়ে পূর্বের কর্মস্থল সিলেট গ্যাস ফিল্ডে ফিরে যান। এতে একটি সহকারী ব্যবস্থাপক পদ শূন্য হয়ে পড়ে।  অন্যদিকে মোঃ মনিরুল ইসলাম বিসিএস (পুলিশ) এ নিয়োগ পেলে বিপিসি ছেড়ে গেলে দু’টি পদ শূন্য হয়ে পড়ে।

আর সেই শূন্যপদে এটিএম সেলিম ও মণি লাল দাশকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মহাজালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কিংবা কোন পরীক্ষার আয়োজনের কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। আবার পুর্বের নিয়োগের সময়ও কোন প্যানেল ছিল না। তাহলে কি করে এই নিয়োগ দেওয়া হলো সেই নিয়ে রয়েছে ধুম্রজাল।

বিপিসি সূত্র জানিয়েছেন, এটিএম সেলিমের চাচা কামাল উদ্দিন ছিলেন বিপিসির প্রভাবশালী কর্মকর্তা। যাকে স্থানীয়রা ডিসি কামাল বলেই জানেন। কামাল উদ্দিন প্রথমে বিপিসি সচিব ও পরে পরিচালক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। তার আর্শীবাদে পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পেয়ে যান এটিএম সেলিম। সোয়েব আহমেদ যোগদান করেছিলেন ১৯৯৯ সালের ১ আগস্টে আর এটিএম সেলিম বিপিসিতে যোগদান করেন ৪ নভেম্বরে। অর্থাৎ পুরোপুরি ৩ মাসের ব্যবধান রয়েছে।

বিপিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, দেখেন নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয় নির্দিষ্ট একটি তারিখ দিয়ে। ৪ মাস সময় দিয়ে নিয়োগপত্র ইস্যু করার নজীর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কখনও কি দেখেছেন কয়েকমাস লম্বা সময় দিয়ে নিয়োগপত্র ইস্যু করতে। এতেই তো প্রমাণ হয়ে যায় এটিএম সেলিমের নিয়োগে জালিয়াতির ইস্যুটি।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

এ বিষয়ে মহাব্যবস্থাপক এটিএম সেলিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার নিয়োগে কোন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেনি। সঠিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছি। অন্যরা যখন যোগদান করেন, তখন কেনো যোগদান করলেন না, এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন বিষয়টি বিপিসির কাছে জানতে চান। আমি কিছু বলতে পারবো না।

তার কাছে প্রশ্ন ছিল আপনি নিয়োগ পেয়েছেন, বিপিসির কাছে যেতে বলার কারণ কি! নিয়োগপত্রের যোগদানের সময় কি কয়েকমাস রাখা হয়েছিল? এটিএম সেলিম এবারও বলেন, এ বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই, বিপিসি ভালো বলতে পারবে।

জনকণ্ঠ পত্রিকার ওই বিজ্ঞপ্তির পর নতুন কোন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল কিনা। তিনি কোন সময় আবেদন করেছিলেন। এসব প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে রাজি হননি এটিএম সেলিম।

অন্যদিকে মণি লাল দাশের নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে সহকারি ম্যানেজার পদের জন্য অভিজ্ঞতাসহ ন্যুনতম দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক পাশ চাওয়া হয়। কিন্তু মণি লাল দাশের স্নাতকের রেজাল্ট তৃতীয় শ্রেণি। এ কারণে বিপিসির ওই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে তার আবেদন করার যোগ্যতাই ছিল না। সেই মণি লাল নিয়োগ পেয়েছেন, আবার সময়ে অসময়ে প্রমোশন পেয়ে মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) পদে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে ভারতে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তিনি এমন কোন বছর নেই ভারত সফর করেন নি। কখনও একাধিক দফায় সফরের রেকর্ড রয়েছে। তদন্ত করা হলের পিকে হালদারের মতো থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে পারে।

পরিকল্পনা বিভাগে নিয়োগ পাওয়া মোঃ মনিরুল ইসলাম চাকরি ছেড়ে দিলে কপাল খুলে যায় মণি লালের। অভিযোগ উঠেছে তিনিও এটিএম সেলিমের মতো পেছনের দরজা দিয়ে আসীন হয়েছেন বিপিসিতে।

এ বিষয়ে একাধিক দফায় ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি মণি লাল দাশ। এমনকি এসএমএস দিলেও সাড়া দেন নি।

এটিএম সেলিম যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগের সূত্র ধরে এটিএম সেলিমের বেপরোয়া  দুর্নীতির তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, সংস্থার হিসাব ও স্বার্থ রক্ষার কথা থাকলেও বরাবরই ব্যক্তিগত হিসেবটাই এটিএম সেলিমের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে।

চান্দগাঁও থানার খালাসী লেকের বিপরীত দিতে ৪ ইউনিটের ৬ তলা বিশিষ্ট বিশাল একটি ভবনের মালিক। নগরীর চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নামে বেনামে একাধিক দোকান। শুধু চট্টগ্রাম নয় দুর্নীতির টাকায় এটি এম সেলিমের সম্পদের সম্রাজ্য গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাতেও।

বিপিসির রন্ধে রন্ধে থাকা দুর্নীতি বন্ধে অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে রেখেছে এটিএম সেলিম চক্র। অটোমেশন হলে দুনীর্তি লুটপাট অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যেতো। বিশেষ করে তেল বিক্রি ও মজুদ এক ক্লিকেই দেখা যেতো। তাতে করে অধীনস্থ কম্পানিগুলো (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) ব্যাংকে টাকা ফেলে রেখে ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে পারত না। যেভাবে বিপিসি খ্যাত, অখ্যাত (ক্রেডিট রেটিংয়ের নিচে থাকা) ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকা জামানত রেখে কমিশন পেয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানের সদরদপ্তর চট্টগ্রামে আর তহবিল রাখা হয়েছে একটি ব্যাংকের উত্তরা শাখায়, কেনো কিসের জন্য সে প্রশ্নের উত্তর সবার জানা।

সরকার যখন জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা বলছে, তখনও বেপরোয়া এটিএম সেলিম। অফিসের গাড়িটি সারাদিন পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সকালে তাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় ছেলে- মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি কখনও চট্টগ্রাম ক্লাবে, কখনও র‌্যাডিসন হোটেলে সাঁতার কাটতে যায়। বিগত কয়েকমাস মাস ধরে চলছে সেই রুটিন। মেয়ের সাতার শেখার ফাঁকে স্ত্রীকে দোকানে আনা নেওয়া করে এ গাড়ি। গাড়ির মাইল মিটার এবং অফিসের সিসি ক্যামেরার রেকর্ড যাচাই করলেই এসব ধরা পড়বে।

নিজের পকেট ভারি করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে ঠেলে দিয়েছেন লোকসানের দিকে। ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আমানত থাকা অবস্থায় (এসএনডি ও এফডিআর) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন ব্যাংক ঋণ নিয়ে। এতে দেখা গেছে, আমানতের বিপরীতে প্রাপ্ত সুদের চেয়ে ঋণের বিপরীতে পরিশোধিত সুদের পরিমাণ ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ ঋণ না নিয়ে নিজেদের আমানত থেকে বিপিসির একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ২৭৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। সবকিছু জেনেও শুধু নিজের মুনাফার ধান্দায় সেই কাজটি করে বিপিসিকে ডুবিয়েছেন এটি এম সেলিম।  এই দুর্নীতির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। ২৩আগস্ট বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি আসম ফিরোজ সাংবাদিকদের বলেন, বিপিসিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কম। তাদের অনিয়মের চিত্র দেখে কমিটি ‘শকড’ (স্তম্ভিত)। বিভিন্ন কেনাকাটা ও নিরীক্ষায় যেসব আপত্তি এসেছে, তাদের সেগুলো সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা কিছুই করেনি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিপিসি চেয়ারম্যানকে ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর