করোনা দর্শন ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মো. মোশররেফ হোসেন খান | 2023-08-27 18:22:09

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম শনাক্ত হয় কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস। এরপর আর তাকে হার মানাতে পারেনি মানব সভ্যতার কোন শক্তি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে; উন্নত অনুন্নত সব রাষ্ট্রে। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন মানুষ, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ১১ মার্চ রোগটিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার শক্তিধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, চিন্তাশীল, বৈজ্ঞানিক সকলেরই ঘুম হারাম হয়ে গেছে আর সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে দিশেহারা ও উদ্বিগ্ন। লকডাউনের পর লকডাউন হচ্ছে দেশের পর দেশ। ফলে আকাশে উড়ছে না উড়োজাহাজ, জল পথে চলছে না জলযান, রাস্তায় চলছে না গাড়ি, বিদ্যালয়ে চলছে না ক্লাস, কল কারখানায় ঘুরছে না চাকা, হাট-বাজার মাঠ-ঘাট সব ফাঁকা। দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, বিনোদন কেন্দ্র, যানবাহন সব বন্ধ; নিস্তব্ধ প্রকৃতি।


সকলের মনের আকুতি করোনাভাইরাস নিপাত যাক ফিরে আসুক স্বাভাবিক জীবন। পৃথিবীর বুকে নেমে আসুক স্বস্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো করোনার এ দুর্যোগ দর্শনের কোন নীতি অনুসরণ করছে বা করবে? নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র, নাকি ম্যালথাসের জনসংখ্যাতত্ত্ব, নাকি ডারউইনের জীবন সংগ্রাম নীতি অথবা হেগেলের নীতি দর্শন- এটাই এখন ভাবার বিষয়।

স্যার আইজাক নিউটন তার বিখ্যাত গ্রন্থ Naturalis Principia Mathematica-তে ১৬৮৭ সালে গতির সূত্রসমূহ প্রকাশ করেন যার তৃতীয় সূত্রটি আমাদের প্রায় সকলেরই জানা যে, “প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।” অর্থাৎ যখন একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে, তখন সেই বস্তুটিও প্রথম বস্তুটির ওপর বিপরীত দিকে সমান বল প্রয়োগ করে। যার কারণে আমরা শক্ত মাটিতে হাঁটতে পারি, রকেট আকাশে উড়তে পারে। এটা প্রকৃতির গতির ক্ষেত্রেও প্রতীয়মান হতে পারে। কেননা মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়ে হীন স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্যে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করছে। উন্নতির নামে খনিজ পদার্থের রূপ পরিবর্তন করে গড়ে তুলছে প্রকৃতিবিরোধী বিভিন্ন স্থাপনা ও তৈরি করেছে নানান বস্তু বা পদার্থ- যেমন, মাটি পুড়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট, পাহাড় কেটে পাথর, বালি দিয়ে বানানো হচ্ছে রাস্তা ও পাকা স্থাপনা, খনিজ তেল ও কয়লা পুড়ে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ, চলছে কল-কালখানা ও যানবাহন। বানানো হচ্ছে পারমানবিক চুল্লি যা থেকে তৈরি হচ্ছে পারমানবিক অস্ত্র। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে গ্রীণহাউজ এফেক্ট, খড়া, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসছে।

এছাড়া অধিক জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে গিয়ে মানুষ হাইব্রিড ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে প্রকৃতির আসল রূপে সৃষ্ট সকল ফল-ফসল, পশু-পাখি, মাছ-গাছ পরিবর্তিত হয়ে তার নিজস্বতা হারাচ্ছে; বিনষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি ও রূপ।

আবার চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক তৈরিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে নানান প্রজাতির ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া যা বিভিন্ন রোগের এন্টিবডি তৈরি করতে টিকা হিসেবেও মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর দেহে প্রয়োগ করা হয় যার ফলে এগুলো তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে জটিল অথবা চরম আকার ধারণ করে। মোট কথা হলো- একটি চরম অবস্থা আরেকটি চরম অবস্থার জন্ম দেয়। যেমন, অতি বৃষ্টির ফলে বন্যা, অতি খরার ফলে দাবানল, অতি ঠাণ্ডার ফলে তুষারপাত ইত্যাদি।

এসব কাজের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অথবা অতি মাত্রায় রোগ প্রতিরোধক আবিষ্কারের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানান প্রাকৃতিক জটিলতা ও রোগ-শোক যার চরম দৃষ্টান্ত হতে পারে করোনাভাইরাস। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস ১৯৭৮ সালে জনসংখ্যা বিষয়ে যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন তাই “ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব” নামে পরিচিত। তার মতে, খাদ্য শস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বাড়ে তখন জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। এই তথ্যানুসারে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বাড়লে খাদ্য সংকট এমনকি দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে যখন কোনো দেশে কাম্য জনসংখ্যার চেয়ে জনসংখ্যা বেশি হয়ে যায়, তখন প্রকৃতি তার নিজস্ব পদ্ধতির মাধ্যমে জনসংখ্যা হ্রাস করে অর্থাৎ কমিয়ে নেয়। অনেক তাত্ত্বিকের মতানুসারে এটার মাধ্যমে ম্যালথাস রোগ-শোক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির কথা বুঝিয়েছেন। করোনাভাইরাস হতে পারে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বেরই বাস্তবায়ন।

বিশ্বব্যাপী এই মহামারি মানুষের জীবনযাত্রাকে যেভাবে থমকে দিয়েছে এর পরিণতি হতে পারে- প্রথমত: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও সবারই মৃত্যু হয় না, তাই এর প্রাদুর্ভাব যতবড় মহামারি আকারই ধারণ করুক না কেনো মানব জাতির অস্তিত্ব বিলীন হবে না। কিন্তু মহামারির হাত থেকে যারা বেঁচে যাবে তারা আবার সেই আদিম যুগের মানুষের মতোই হয়ে যেতে পারে! কেননা কল-কারখানা, গাড়ি-ঘোড়া, বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম, সকল প্রকার যানবাহন, স্কুল কলেজ সবই হয়ত থাকবে।

কিন্তু এগুলো চালানোর মত দক্ষ লোক থাকবে না। ফলে কৃতিমভাবে তৈরি সবকিছু আস্তে আস্তে বিকল ও বিলীন হয়ে যাবে। মানুষ তখন জোড় যার মুল্লুক তার -এ নীতি অবলম্বন করতে পারে। এমতাবস্থায় ডারউইনের “জীবন সংগ্রাম (Struggle for existence)” নীতির বাস্তবায়ন ঘটবে।

বিবর্তনবাদী দার্শনিক চার্লচ ডারউইন তার বিখ্যাত গ্রন্থ The Origin of Species-এ এ নীতির অবতারণা করেন। তিনি মনে করেন, জগতে জীবকে বেঁচে থাকতে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। জগতে যত জীব আছে তাদের অনুপাতে পর্যাপ্ত খাদ্য জগতে নেই ফলে খাদ্য লাভের জন্য জীবদের ভেতর প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। এ প্রতিযোগিতা এতই তীব্র যে, স্বাভাবিকভাবেই তা দ্বন্দ্বের আকার ধারণ করে। চার্লচ ডারউইন এর নাম দিয়েছেন “জীবন সংগ্রাম।”

তার মতে, জীবন সংগ্রামে যেসব জীব জয়ী হয় তারা প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে বেঁচে থাকে আর তারাই হলো যোগ্যতম এবং তাদেরই বাঁচার অধিকার আছে মানে- Survival Of the Fittest. আর যারা হেরে যায় তারা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায়। করোনার প্রভাবে মানব জাতির নিজেদের মধ্যেও হয়ত এমন অবস্থা হতে পারে এবং যোগ্যতমরাই বেঁচে থাকবে।

দ্বিতীয়ত: হয়ত অল্প দিনের মধ্যেই করোনা মানুষের সাথে বৈজ্ঞানিক যুদ্ধে হেরে গিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেবে অথবা অন্যান্য ভাইরাসের মতো থমকে যাবে। তখন মানব সভ্যতায় আসবে আমুল পরিবর্তন। ঐ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য হেগেলের নীতি দর্শনকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা করোনার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে কর্মী তার চাকরি হারাবে, ব্যবসায়ী তার ব্যবসা হারাবে, শিল্প মালিক তার মূলধন হারাবে, কৃষক তার ফসল হারাবে ইত্যাদি ইত্যাদি- অর্থাৎ সব কিছুতে আসবে এক নতুন মাত্রা। এ অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য কর্মী চাইবে যেকোনো মূল্যে তার চাকরি, ব্যবসায়ী চাইবে বেশি ব্যবসা, শিল্প মালিক চাইবে মূলধন ফিরে পেতে, কৃষক চাইবে বেশি ফসল ফলাতে ইত্যাদি। মোট কথা হলো সবার মধ্যে একটি অজানা হাহাকার দেখা দেবে। তখন হেগেলের নীতি দর্শনকেই গুরুত্ব দিতে হবে। এ নীতি দুটি হলো “মানুষ হও” এবং “মরে বাঁচো। “মানুষ হও” অর্থাৎ মানুষের মনুষ্যত্ব ফুটে ওঠে নিজ হীনস্বার্থ প্রবৃত্তি বিলীন করে জ্ঞান-যুক্তি-বুদ্ধি-প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হয়ে পরের কল্যাণ ও মঙ্গলের সাধনায়।

করোনার প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে অবশ্যই অমন মানুষ হতে হবে। “মরে বাঁচো (Die to Live)” মানে মনুষ্যত্বের বিকাশ। পশু বা হীনবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে মানুষ আত্মব্যাপ্তি লাভ করতে পারে না এবং সুন্দর বৃহত্তর জীবনের স্বাদও গ্রহণ করতে পারে না। প্রকৃত জীবন হচ্ছে বুদ্ধি-প্রজ্ঞা ও যৌক্তিক জীবন। এ প্রকৃত জীবন মানুষকে অপরাপর মানুষের সাথে একাত্মবোধ-সহমর্মিতা জাগিয়ে তোলে।

মোট কথা হলো করোনার মহামারির প্রভাব থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে মানুষকে আরো মানবিক হতে হবে। অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা, হানাহানি, মারামারি না করে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নেমে পরতে হবে কাজে। অর্থাৎ মানুষের মত মানুষ হতে হবে। অতীতকে ভুলে গিয়ে সুন্দর আগামীর জন্য হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ রেখে বেশি কাজ করতে হবে। তবেই পৃথিবী ফিরে পাবে তার আসল রূপ। না হলে বড়দের বাঁচতে হবে হাফাতে হাফাতে আর ছোটদের বাঁচতে হবে ধুঁকে ধুঁকে।


মো. মোশররেফ হোসেন খান: অধ্যাপক, আলহাজ্জ হযরত আলী ডিগ্রী কলেজ, বরিশাল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর