‘ইমিউনিটি’ই ভরসা!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-18 12:29:15

করোনা পরিস্থিতি এখন নতুন মোড় নিয়েছে। সেটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই। করোনার প্রাথমিক থাবায় তার ক্ষতির সামর্থ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেছে। যদিও করোনা একেক দেশে একেক রকমের ক্ষতি করতে পেরেছে। বলা ভালো, একেক দেশ তার রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকও স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষমতা দিয়ে করোনার মোকাবিলা করেছে এবং তার ফলও ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। এখন দেখার বিষয় করোনা নতুন করে আর কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। কেননা করোনা তার কাজ যতটা এগিয়েছে মানুষ তার কাজ ততোটা এগোতে পারেনি।

এখনও করোনার ভ্যাকসিন বা নিশ্চিত প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। করোনা আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করার চেষ্টায় নানা রকম ওষুধ ব্যবহারের চেষ্টা চলেছে বটে কিন্তু সর্বসম্মত নিশ্চিত কোন ওষুধের দেখা মেলেনি। যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত প্রতিষেধক মিলছে না ততক্ষণ নানা রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দিয়েই করোনা মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে করোনা আমাদের ‘লকডাউন’, ‘হোমকোয়ারেন্টিন’,‘আইসোলেশন’,‘স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি’-নানাবিধ আচার শিখতে ও মানতে বাধ্য করেছে।

৬ মে ২০২০ তারিখ পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৭০৫ জন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫০জন। করোনাভাইরাস বিষয়ে এসব তথ্য দিচ্ছে www.worldometers.info। বলা ভালো বিভিন্ন দেশের সরকার যে তথ্য দিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করেই এই ওয়েবসাইটে করোনা বিষয়ক এসব তথ্য মিলছে। সুতরাং এই হিসাবকে সরকারিভাবে পাওয়া তথ্য হিসেবেই দেখতে হবে। বেসরকারিভাবে পাওয়া তথ্য হয়তো এর চাইতে ভিন্ন হলেও হতে পারে।

এই ওয়েবসাইটের তথ্য মতে করোনাভাইরাসে ইনফেকটেটড বা আক্রান্ত যারা হচ্ছে তাদের মধ্যে শতকরা ৯৮ জন মাইল্ড কন্ডিশনে আছেন, এদের অবস্থা ততটা খারাপ নয় বা এদের নিয়ে ভয়ের তেমন কারণ নাই। কিন্তু আক্রান্তদের মধ্যে খুব খারাপ বা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে মাত্র ২ শতাংশ করোনা রোগী। বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মেনে যারা আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিন বা চিকিৎসকদের পরামর্শ মানতে পারছেন তাদের ৮৩ শতাংশ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছেন। অর্থাৎ তাদের দেহের রক্ত পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ মিলছে। এই ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে বিশ্বব্যাপী যাদের করোনা হয়েছিল, যাদের চিকিৎসা লেগেছে তাদের একটা বড় অংশ (৮৩%) সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেও ২ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৪ জন রোগী মারা গেছেন।

দেখার বিষয় হচ্ছে, আমেরিকা, স্পেন, ইটালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স-এই পাঁচ দেশে করোনাভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষ। ৮ মে ২০২০ তারিখের সর্বশেষ হিসাব বলছে, আমেরিকায় ৭৬ হাজার ৯৩৮ জন, স্পেনে ২৬ হাজার ৭০ জন মানুষ করোনায় মারা গেছেন। বলা ভালো, এর দুদিন আগে ৬ মে ২০২০ তারিখে আমেরিকা ছাড়া স্পেন, ইতালি, ব্রিটেন ও ফ্রান্স-এই চার দেশে করোনায় কোনো রোগী মারা যায়নি। এদিন আমেরিকায় করোনায় মারা গেছে মাত্র ৪ জন। ব্যাপক প্রাণহানির পর আমেরিকা, স্পেন, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স-এই পাঁচ দেশে করোনার ক্ষতি করার ক্ষমতা কমে আসছে। অন্যদিকে করোনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর রাশিয়া নিজেকে কঠোর লকডাউনে রেখে করোনা আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুহার দুটোই কমাতে পারলেও বর্তমানে সেখানে মৃত্যুহার বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। এটি রাশিয়াতে করোনার ভয়াবহতা বাড়ার ইংগিত দিচ্ছে। একইভাবে ব্রাজিল,মেক্সিকো, বেলজিয়ামে করোনা রোগে মানুষের প্রানহাণির সংখ্যা বাড়ছে।

০২.

এবার বাংলাদেশের দিকে নজর দেয়া যাক। বাংলাদেশে করোনা টেস্টের হার অপ্রতুল। বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খুব সংখ্যক মানুষকেই করোনা টেস্টের আওতায় আনা গেছে। বলা যায় বিশ্বের নিরিখে এই টেস্টের বিবেচনায় বহু দেশের নীচেই বাংলাদেশের অবস্থান। ৬ মে ২০২০ তারিখে আইইডিসিআরের [রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট] ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্যমতে সর্বমোট ৯৯ হাজার ৬৪৬ জনকে করোনা টেস্ট করা হয়েছে।

১৬কোটি মানুষের দেশে এখনো এক লাখ মানুষকেও টেস্টের আওতায় আনা যায়নি। এটা একদিকে আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার সক্ষমতার অবস্থানকে নির্দেশ করে। আমাদের যে সংখ্যক (৯৯,৬৪৬) মানুষকে করোনা টেস্ট করা হয়েছে তার মধ্যে ১২ হাজার ৪২৫ জনের মধ্যে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আমাদের যে সংখ্যক মানুষকে টেস্ট করা হয়েছে তার মধ্যে ১১.৭% মানুষ তাদের শরীরে করোনা ভাইরাস বহন করছে। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৯ জন। করোনা আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুহার ১.৫৮%।

৬ মে ২০২০ থেকে বিগত সাত দিনের ডাটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যত সংখ্যক মানুষকে করোনা টেস্ট করা হয়েছে তাদের মধ্যে যথাক্রমে ১২.৫৬%, ১৩.৭৬%, ১০.৯৯%, ১২.৩৮%, ৯.৪৭%, ১০.২৪%, ১১.৩৫% মানুষের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। এটা এখন পরিষ্কার যত বেশি মানুষকে টেস্ট করা যাচ্ছে তত বেশি করোনা আক্রান্ত মানুষের দেখা মিলছে। করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে যত মানুষ মারা গেছে তার মধ্যে ২৭% নারী এবং ৭৩% পুরুষ। মৃত মানুষদের মধ্যে ৪২% মানুষের বয়স ষাটের বেশি। ২৭% মানুষের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর। ১৯% মানুষের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সসীমার মধ্যে মারা গেছে ৭%। কিন্তু আক্রান্ত রোগীদের ২৬%- এর বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর। ২৪%-এর বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছর। অর্থাৎ তরুণরাও ব্যাপকভাবেই করোনারোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যদিও মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৬০ বছর বয়সীদের সংখ্যাই বেশি। তথ্য বলছে, বাংলাদেশের করোনা আক্রান্ত রোগীদের বড় অংশ হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর।

বলা যায় করোনা প্রাদুর্ভাবের পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার দুর্বলতার চেহারা প্রকটভাবেই ফুটে উঠেছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে যেয়ে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন। চিকিৎসকদের সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব এবং মান নিয়ে বহু অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বিশেষত সার্কভুক্ত দেশগুলোর পরিস্থিতির মতই। এসব তথ্য আমাদের দুটো বার্তা দিচ্ছে:

এক. যত বেশি টেস্ট করা হবে তত বেশি করোনা পজিটিভ পাওয়া যাবে।

দুই. বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার সংখ্যা এখনো পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় যথেষ্ট কম।

০৩.

আমরা সরকারিভাবে দেশে লকডাউন করিনি বরং সাধারণ ছুটি পালন করছি শর্তসাপেক্ষে। ইতোমধ্যে সরকার গার্মেন্টস খুলে দিয়েছে, মসজিদ নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে, বাজার-দোকান খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শর্ত সাপেক্ষেই। কারণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে লকডাউন পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সরকার প্রথম দিকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও প্রশাসন-সেনাবাহিনী দিয়ে কঠোরভাবে লকডাউন মানানোর চেষ্টা করেছে। কেননা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশের একটা বড় অংশের মানুষের পক্ষে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। জীবিকার তাগিদেই তাদের ঘরে থেকে বের হতে হয়েছে। এটা একটা দিক। আবার সামাজিকভাবে লকডাউনের মত নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি লম্বা সময় ধরে মেনে চলার মত জাতিগত বৈশিষ্ট্যও আমরা ধারণ করি না। অন্যদিকে লকডাউন কঠোরভাবে প্রতিপালনের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যে সক্ষমতার দরকার সেটাও আমাদের নেই। ফলে, অর্থনীতির তাগিদে প্রচণ্ড স্বাস্থ্যগত ও মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই সরকার ক্রমশ সবকিছু উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সব রকম ঝুঁকি বিবেচনা করেই সরকার ‘হার্ড ইমিউনিটি’কেই সমাধান ভাবছে। অর্থাৎ অনেক লোক সংক্রমিত হলে সর্বসাধারণ প্রাকৃতিকভাবেই ভাইরাস প্রতিরোধী হয়ে উঠবে।। সেটাই এখন ভরসা। ‘হার্ড ইমিউনিটি’-কেই ভরসা ধরে সরকার তার নীতিকৌশল ঠিক করছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত এখন কতটা ফলদায়ক হয় সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর