করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলাই বড় চ্যালেঞ্জ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-30 20:23:38

করোনাকাল কেটে যাবে। মহামারি চিরদিন থাকবে না। মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। কিছু দেশ ইতোমধ্যে লকডাউন শিথিল করে তাদের দীর্ঘ ঘরবন্দী জীবনের ইতি টানতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। শুধু ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই করোনাকালে এখানে চলছে পুরোদমে ছুটি ও ঢিলেঢালা লকডাউন। হয়তো অল্পদিনের মধ্যেই ঢিলেঢালা লকডাউনও থাকবে না। সবকিছু স্বাভাবিক হোক এটা আমরা সবাই চাই।

করোনা পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে এ নিয়ে চলছে নানা গবেষণা ও পূর্ব ধারণা। কিন্তু এ বিষয়ে শেষ কথা বলা সম্ভব না। আগামী দিনের বিশ্ব কেমন হবে তা সময়ই বলে দেবে।

তবে করোনা পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় খুব একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, এ বৈশ্বিক মহামারিতে কম বেশি সব দেশই আক্রান্ত। মৃতের সংখ্যা যা-ই হোক, অর্থনীতির ওপর আঘাত সবাইকেই কমবেশি কাবু করে দিয়েছে। ফলে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আগের মতোই বিরাজ করবে। এমন নয় যে করোনার আজাব তাদের মধ্যে এক বিরাট মানসিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যার ফলে তারা তাদের মধ্যে এতদিনের শত্রুতা ভুলে একে অপরের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াবেন। কাজেই মনে হচ্ছে, পুরনো শত্রুতা আগের মতোই বিরাজ করবে।

কিন্তু করোনা আমাদের শিখিয়ে গেলো আগামী দিনের আসল শত্রু সে (করোনা বা তার মতো ভাইরাস ইত্যাদি) নিজেই। আগামী দিনের বিশ্বে করোনা আসবে নতুন রূপে, নতুনভাবে, নতুন নামে- কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বিপাক রূপে, কখনো জলবায়ু পরিবর্তনের ফল হিসেবে, কখনো বা ভাইরাস-মহামারি হিসেবে, কখনো ক্ষুধা-দারিদ্র, জানা-অজানা নানা রোগ বালাই হিসেবে। মানুষের এই তৃতীয় শত্রুই আসল শত্রু। কিন্তু তারপরও মানুষ নিজেদের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধংদেহি মনোভাবের বদলে মানবজাতির এই কমন শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হবে না। এটাই হচ্ছে মানবজাতির সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। অথচ পরিচিত শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে ভাইরাস বা দুর্যোগের মতো অপরিচিত ভবিষ্যৎ শত্রুর মোকাবিলা আরও সহজ হতো। সেট না হলে অজানা শত্রুর সঙ্গে একাই লড়তে হবে একেকটি দেশ ও জনপদকে।

করোনা বিশ্বকে দেখিয়ে গেলো যে তার ক্ষমতা মানুষের তৈরি আণবিক বোমার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যে বিশ্বমোড়লরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সারাজীবন বিভোর থাকেন করোনা আঘাত হেনেছে সেই ক্ষমতার কেন্দ্রেই। ইউরোপ-আমেরিকাই আজ করোনায় সবচেয়ে বেশি নাস্তানাবুদ। করোনা নামক এই অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে খোদ আমেরিকায়ই তিন মাসের কম সময়ে মারা গেছে প্রায় ৭০ হাজারের ওপরে মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধে জড়িয়েও এত আমেরিকান মারা যায়নি। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের অবস্থাও একই। গত পঞ্চাশ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধেও ব্রিটেনের এত সৈন্য মারা যায়নি। কাজেই করোনার মতো অজ্ঞাত শত্রুই যে আগামীর সবচেয়ে বড় শত্রু এটি পরিষ্কার। শত্রুকে চেনাটাই যুদ্ধ জয়ের প্রথম পাঠ। সে পাঠ বিশ্বমোড়লরা এখনও শুরু করেননি। ফলে, শুধু ভাইরাস নয়, জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলা, পরমাণু অস্ত্র বা মারাণাস্ত্র হ্রাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে এখনও তাদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম অনৈক্য ও অসহযোগিতা। ফলে, আগামী দিনের কমন শত্রু মোকাবিলায় দেশগুলো আরও শক্তিহীন হয়ে পড়বে- হোক সে ভাইরাস, পঙ্গপাল, অথবা জলবায়ু ও প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দুর্যোগ-দুর্বিপাক।

আমরা এতদিন জেনেছি জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু জয় করে ফেলেছি। একথা সত্য যে আমাদের অর্জনও কম নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তিতে আমরা আরও এগিয়ে যাব এতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও প্রকৃতির শক্তির বিরুদ্ধে আমরা অসহায় করোনা সে কথাটাই মনে করিয়ে দিল পুরো বিশ্ববাসীকে একসঙ্গে। এর আগে একেকটি দুর্যোগ বা মহামারি ইত্যাদি আঘাত হেনেছে একেকটি জনপদে সীমিত আকারে। এবার বৈশ্বিকভাবে, বাঁধ ভেঙে।

আসলে প্রকৃতির জানা-অজানা শত্রুর শক্তি সম্পর্কে আমাদের এখনও অনেক ধারণা নেই। প্রকৃতির খামখেয়ালির ওপর আমাদের হাত নেই। ভবিষ্যতে করোনার চেয়েও বেশি শক্তিশালী কোনো ভাইরাস যে আমাদের ওপর আঘাত হানবে না তার নিশ্চয়তা নেই। কাজেই রাষ্ট্রগুলোর বিপুল অর্থসম্পদ ও শক্তির মদমত্ততা কোনোই কাজে আসবে না যদি না এসব দুর্যোগে মোকাবিলা না করা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে আজ করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া। আরেক পরাশক্তি চীন করোনার আঁতুড়ঘর। কাজেই সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিই শেষ কথা নয়। বস্তুবাদী দার্শনিক অস্ট্রিয়ার ভিটগেনস্টাইন মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, ‘দর্শন ও বিজ্ঞান যদি জীবনের প্রধান বিষয়গুলোর সমাধান খুঁজে বের করে, তারপরেও থেকে যাবে মানবজীবনের দুর্ভেদ্য রহস্য।’

যেকোনো বালা-মুসিবত-দুর্যোগ-দুর্বিপাক ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হয়। সব সময় মানুষের সব শক্তি কাজে লাগে না। একেক যুদ্ধে একেক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। কামান দিয়ে মশা মারা যায় না, তাতে শক্তিরই অপচয় হয়। সব যুদ্ধেই উপযুক্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। তবে সব দুর্যোগ-দুর্বিপাকে প্রাথমিক ও প্রয়োজনীয় শক্তি মানবিকতা ও ঐক্য। একা একা বাঁচা যায় না। একা একা মরা যায়।

করোনাকালে আমরা দেখছি অন্যান্য দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধে শামিল হয়েছে। তারা দল-মত নির্বিশেষে দেশের জন্য কাজ করছে। এখন আন্তর্জাতিক অস্ত্র ও শক্তি প্রদর্শনী ও অভ্যন্তরীণ ঝগড়া-ফ্যাসাদ সব দেশেই বন্ধ। কিন্তু আমাদের দেশই এর ব্যতিক্রম। এখানে ত্রাণ নিয়ে যেমন তেলেসমাতি হচ্ছে, আবার এ নিয়ে রাজনৈতিক বাহাস হচ্ছে তার বেশি। দেশের এই চরম দুর্দিনেও দেশের জনপ্রতিনিধিদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কম কথা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইইডিসিআর, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর হাতে গোনা কয়েকজন মন্ত্রীই গণমাধ্যমে হাজির হয়ে যা কিছু বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। বাকিদের দেখা নেই। আর দেশের বিরোধীদলগুলোতো আগে থেকেই লাপাত্তা। তারা করোনা আসার আগে থেকেই রাজনৈতিক কোয়ারেন্টিনে। এখানে দেশের দুর্দিনেও রাজনৈতিক ঐক্য কাজির গোয়ালের গরুর মতো। দেশের প্রধানমন্ত্রীকেই সবকিছুই সামাল দিতে হচ্ছে। বিধি ডান-আওয়ামী লীগ একজন শেখ হাসিনা পেয়েছিল আর বাংলাদেশ একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছিল। ফলে তাকেই বহন করতে হচ্ছে সব ভার। বাকিরা সব রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনার ভাইরাসে আক্রান্ত।

করোনার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ শুধু করোনাকালীন যুদ্ধই নয়। আলোচনা-সমালোচনা করে রাজনৈতিক ঠেক দেয়া যায়, অর্থনীতিকে ঠেক দেয়া যায় না। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক যুদ্ধটি আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় তিন মাস ধরে আমাদের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে আছে। উৎপাদনে নেই শিল্প ও কৃষিখাত। টেকসই অর্থনীতির জন্য যেমন শিল্পের চাকা চলমান রাখতে হবে, তেমনি আশু খাদ্য ঘাটতি মেটাতে কৃষি উৎপাদনও অব্যাহত রাখতে হবে। বিশ্বের ধনী দেশগুলো খাদ্য উৎপাদনের ওপর আগে থেকেই জোর দিচ্ছে। খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ধনী রাষ্ট্রগুলোর জোট জি-২০'র কৃষি মন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে এক ভিডিও সম্মেলন করেন সেখানে তারা নিজ দেশের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সে লক্ষে কিছু সুপারিশও তারা করেছেন।

এখন বিশ্বব্যাপীই লকডাউন চলছে। নিজে দেশের কৃষি উৎপাদন অনেক দেশেই ব্যাহত। ফলে ওই দেশগুলো আগে তাদের নিজেদের খাদ্য ঘাটতি পূরণের কথা চিন্তা করবে এবং প্রয়োজনীয় মজুদ করে তারপর রপ্তানির কথা ভাববে। বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানি এখন বন্ধ আছে। লকডাউন উঠে গেলে বা করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যে আবার আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়ে যাবে সে রকমটি নাও হতে পারে। আগে রপ্তানিকারক দেশ নিজ দেশের বর্তমান ও আগাম চাহিদার হিসেব করে ও যথেষ্ট মজুদ রেখেই রপ্তানি করার কথা চিন্তা করবে। ফলে যে সব দেশে প্রাথমিক খাদ্য পণ্যের জন্য অপর দেশের ওপর নির্ভরশীল তাদের জন্য খাদ্য ঘাটতি একটি আশু সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে দেখি, রাশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াসহ ১০টিরও বেশি দেশ শস্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতে ধনী দেশগুলো বেশি বিপদে পড়বে। সে কারণেই জি-২০ জোটের দেশগুলোর মাথা খারাপ অবস্থা। কারণ খাদ্য পণ্যের বড় ভোক্তা তারাই। ফলে এই রাষ্ট্রগুলো বৈশ্বিক আমদানি রপ্তানি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে বাণিজ্যিক কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এক রকম হুঁশিয়ারিও দিচ্ছে।

সংকট শুধু খাদ্যপণ্য নিয়েই নয়। কমবেশি সব কিছুর ওপরই পড়েছে করোনার প্রভাব। বিশ্ববাজারে তেলের দাম ভীষণভাবে পড়ে গেছে। বিনে পয়সায়ও মানুষ আজ তেল কিনছে না। তেলের মজুদ বাড়ছে কিন্তু চাহিদা নেই, ফলে সরবরাহও নেই। তেলের বাজারে এই ধ্বসের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতেও পড়বে এর প্রভাব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে তাদের সময় লাগবে। আমাদের দেশে খাদ্য, কৃষি, শিল্প সবক্ষেত্রেই রয়েছে সংকটের হাতছানি। তৈরি পোশাক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো না। পুরো বিশ্বের পোশাক বাজারেই আজ ধ্বস। নতুন চাহিদা, ওয়ার্ক অর্ডার, উৎপাদন ও সরবরাহ চক্র সৃষ্টি হওয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ। ফলে এই খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। আমাদের পোশাক শ্রম বাজারেও পড়বে এর প্রভাব।

তবে এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ করোনা বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়া। একই সঙ্গে আগাম যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত হওয়া। ফল সামাজিক নিরাপত্তা ও খাদ্য-নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সরকারের একার কাজ নয়, সম্ভবও নয়। করোনায় কেউ আক্রান্ত হবে, কেউ হবে না। আবার আক্রান্তদের অনেকেই সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে সেখানে সবাই আক্রান্ত হবেন। কেউ পার পাবেন না।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর