ভোট আর পূজা এক সাথে হতে পারে না

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-26 19:37:16

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরপরই সরস্বতীয় পূজার তারিখটি আলোচনায় আসে। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের কেউ কেউ ফোন করে সরস্বতী পূজার দিনেই ভোটের তারিখ দেয়ায় ক্ষোভের কথা জানাচ্ছিলেন।

আমি তাদের বলেছি, নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে। এটা এমন কোনো ব্যাপার নয়। নির্বাচন কমিশনের নজরে আনলেই বিষয়টি মিটে যাবে। দুদিন পর জানলাম, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা নির্বাচন কমিশনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছেন, স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু আমার বিস্ময়ের সীমা পার করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি আমলে নেয়নি। এমনকি হাইকোর্টও নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের জন্য করা রিট সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন।

আমার আসলে বিস্মিত হওয়ার সীমাও হার মেনে যায়। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্রে পূজার দিনে ভোট হবে, এটা আসলে অবিশ্বাস্য।নির্বাচন কমিশন এবং হাইকোর্টে প্রতিকার না পেয়ে সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নেমেছে।

বিক্ষোভ, অবরোধের পাশাপাশি এখন তারা ভোটের তারিখ বদলানোর দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেছে। পাশাপাশি হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছে।
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছেন নির্বাচন কমিশন সচিব। তিনি বলেছেন, ভোট গ্রহণের তারিখ আগানোর বা পেছানোর সুযোগ নেই। তার দাবি শিক্ষার্থীরা না বুঝেই আন্দোলন করছেন। তার কথা শুনে আমার আসলে মনে হচ্ছে, তিনি একটি ধর্মের মানুষের আবেগ না বুঝেই সচিবগিরি করছেন।

এখন যতটা বড় আকার ধারণ করেছে, বিষয়টা কিন্তু তত বড় নয়। ভোট গ্রহণের তারিখ পেছানোর কোনো সুযোগ হয়তো নেই। কারণ ভোটের একদিন পরেই, ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। তবে একদিন এগিয়ে আনতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নেই। মূল প্রার্থীদের অনেকেই শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, ভোটের তারিখ বদলানোর দাবি জানিয়েছেন।

আশা করি আলোচনার ভিত্তিতে একদিন এগিয়ে আনলে প্রার্থীরা কেউ মাইন্ড করবেন না। নির্বাচন কমিশন কেন, ছোট বিষয়টিকে এমন জটিল করে ফেলছেন, সেটাই আমার মাথায় ঢুকছে না।

সাধারণত নির্বাচন, পরীক্ষা এমনকি রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার আগেও ক্যালেন্ডার মিলিয়ে দেখা হয়। যাতে অন্য কোনো অনুষ্ঠান, বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে মিলে না যায়। কারণ নির্বাচন, পরীক্ষার তারিখ বদলানো যায়; কিন্তু ধর্মীয় উৎসবের সময় প্রকৃতিনির্ভর ও পূর্বনির্ধারিত।

তাহলে কী ভোটের তারিখ ঠিক করার আগে নির্বাচন কমিশন ক্যালেন্ডার দেখেনি? আমার ধারণা দেখেছে। তারপরও ভুলটা হয়েছে। ভুলের উৎস খুজতে আমাদের আরেকটু পেছনে যেতে হবে। জটিলতার পুরো দায় অবশ্য নির্বাচন কমিশনের নয়। সারাবছরের সরকারি ছুটি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি চিহ্নিত করে সরকার একটি ক্যালেন্ডার বানায়। সেই ক্যালেন্ডারই সবাই ফলো করে। সরকারের সেই ক্যালেন্ডারে সরস্বতী পূজার ছুটি নির্ধারিত আছে ২৯ জানুয়ারি। পূজার ছুটির এই তারিখ নির্ধারণের ভুলটিও হয়েছে আরকটি বিভ্রান্তি থেকে।

এবারের সরস্বতী পূজার তিথি শুরু হবে ২৯ জানুয়ারি সকাল সোয়া ৯টায়, শেষ হবে ৩০ জানুয়ারি সকাল ১১টায়। তবে সরস্বতী পূজা উদযাপিত হবে ৩০ জানুয়ারি সকালে। সমস্যা হলো পূজার তিথির শুরুটা দেখে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা একদিক দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। জাতীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের সবদিক বিবেচনা করেই নেয়া উচিত।

একটা ভুল থেকে আরেকটা ভুল, আরেকটা ভুল থেকে আরেকটা ভুল- এভাবে পুরো বিষয়টা জট পাকিয়ে গেছে। পুরো জট এক নিমেষেই খুলে ফেলা সম্ভব, ভোট গ্রহণের তারিখ একদিন এগিয়ে আনলেই হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ছেলেমানুষের মত গো ধরে বসে আছে। যেন ভোটের তারিখ বদলালে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। এমনিতে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের নামে যা করছে ইদানিং, তাতে তাদের ধিক্কার দেয়ার আগ্রহও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। এবার একটি সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় উৎসবের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান না দেখিয়ে কমিশন তাদের জন্য মানুষের ঘৃণার বরাদ্দটা আরো বাড়ালো।

সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতারও বিস্তার ঘটেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়তে শুভচিন্তার মানুষদের আরো বেশি সক্রিয় থাকতে হবে। মানুষকে আমি কখনো ধর্ম দিয়ে, জাতি দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, লিঙ্গ দিয়ে বিবেচনা করি না। তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু। তাই আমরা যারা ধর্ম পরিচয়ে সংখ্যাগুরু, তাদের উচিত সংখ্যালঘুদের পাশে দাড়ানো, তাদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা।

ভোটের তারিখ বদলানোর দাবিটা মুসলমানরা তুলতো, রিটটা যদি কোনো মুসলমান করতেন, আন্দোলনের সামনে যদি মুসলমান শিক্ষার্থীরা থাকতো; তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের মর্যাদা আরো বাড়তো। একটি দেশের সংখ্যাগুরুরা ভালো হলে, সংখ্যালঘুরা নিশ্চিন্তে থাকে। আমরা নিশ্চয়ই ভালো হতেই চাইবো। তাই সংখ্যালঘুদের সকল ন্যায্য দাবিতে তাদের পাশে থাকতে হবে, সম্ভব হলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সংখ্যালঘুরা সংখ্যায় কম, তাদের প্রতিবাদের আওয়াজ কম। দাবি যদি ন্যায্য হয়, তাহলে সবাইকে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে।

আমাদের দেশে ভালো ও সংবেদনশীল মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তবুও চারপাশে কিছু অসহিষ্ণু, অসংবেদনশীল, অযৌক্তিক মানুষ দেখি। ফেসবুকে একজন বলেছেন, পূজাটা দুদিন পরে করলে কী হয়? আমি বিস্ময়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ ছিলাম। এখন তাকে যদি বলি, ঈদ কি চাইলে দুদিন পিছিয়ে দেয়া যাবে? উনি কিন্তু চাপাতি নিয়ে আমাকে মারতে আসবেন।

আরেকজন বলছেন, হিন্দুদের ১২ মাসে ১৩ পূজা; সব পূজার হিসাব রাখলে তো দেশ অচল হয়ে যাবে। তিনি পাশের কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন, সরস্বতী পূজা অন্য সব পূজার মত নয়। দুর্গা পূজার পরেই হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব সরস্বতী পূজা। সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তাই ঘরে ঘরে তো সরস্বতীর পূজা হয়ই, তারচেয়ে বেশি হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এখানেই ভোটের সাথে শত্রুতা। ভোট কেন্দ্রও যে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। তাই নির্বাচন কমিশনেরর অবুঝ সচিব যতই বলুন ভোট আর সরস্বতী পূজা একসাথে হতে পারে না।

অনেকে বলছেন, চাইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাসায় পূজা করে ভোট দিতে আসতে পারে। চাইলে হয়তো পারে। কিন্তু চাইবে কেন? সিটি করপোরেশন নির্বাচন তো কোনো জাতীয় দুর্যোগ নয় বা এর তারিখও অপরিবর্তনীয় নয়। স্যাক্রিফাইস যদি করতেই হয়, সেটা একটি সম্প্রদায়ের মানুষ কেন করবে, কেন নির্বাচন কমিশন নড়বে না? নড়ানড়ির চেয়ে বড় কথা হলো, বিষয়টা নিছক ভোটের নয়; একটা সম্প্রদায়ের আবেগ, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাব।

এর আগে শারদীয় দুর্গোৎসবে সপ্তমীতে রংপুর উপনির্বাচন করে নির্বাচন কমিশনের বাড় বেড়েছে। বারবার আপনারা একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবকে অবজ্ঞা করবেন, উপেক্ষা করবেন, হেয় করবেন; এটা চলতে পারে না। একবার ভাবুন তো- ঈদ দূরে থাক, শবে বরাত, শবে মেরাজ, আশুরা বা ঈদে মিলাদুন্নবী; এমরকি শুক্রবারেও বাংলাদেশের কোথাও ভোট গ্রহণের কথা ভাবতে পারবে নির্বাচন কমিশন? আমরা চাই না, এমন কথা কেউ ভাবুক।

তবে সেই ভাবনাটা হতে হবে সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত এই বাংলাদেশে সবার নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার পূর্ণ অধিকার আছে। এই বাংলাদেশ যতটা রহিমের; ততটাই রামের, বড়ুয়ার, জনের, গারোর, চাকমার।

বাংলাদেশে ভোট একটি উৎসব। সরস্বতী পূজাও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উৎসব। এক উৎসব যেন আরেক উৎসবকে মাটি করতে না পারে; সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর