উইপোকা ও ইঁদুর সমাচার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 09:43:56

আমাদের সমাজে ‘আমরা পোকা’ নামক এক দাঁতালো উইপোকা শ্রেণির আবির্ভাব হয়েছে। এই উইপোকারা পোকা নয় বরং ইংরেজি ‘উই’ বা ‘আমরা পোকা’।

আমরা এই ‘আমরা পোকাকে’ নিজেরা প্রশ্রয় দিয়ে বড় করেছি। ‘আমরা পোকারা’ আমাদের প্রাণ ভোমরা। এদের আছে অনেক টাকা-কড়ি, ডলার, সোনা, মণি-মুক্তা। সে টাকার ভাগ মাসে মাসে কেউ ব্যাগ ভরে নিয়ে আসি। ওরা কাউকে কাউকে এমনিতেই কাঁড়ি কাঁড়ি কড়ি দিয়ে দিলেও ওই অর্থ দেখিয়ে সরকারকে কর দেয়ার সুযোগ নাই। এদের মাথায় হাত বুলাতে আমরা অভ্যস্ত। তাই ওদের গায়ে হাত তুলতে বাধে!

দীর্ঘদিন ধরে এই 'আমরা পোকারা' উন্নয়নের রশিকে কেটে কুটে ছোবড়া বানিয়ে আসছে। সেসব ছোবড়া উন্নয়নের পথ চলতে হোঁচট সৃষ্টি করেছে। সেটাই আজকের বাংলাদেশের জন্য বড় বিড়ম্বনা।

কয়েকদিন হলো আমাদের দেশে উইপোকা ও ইঁদুরে উন্নয়ন খেয়ে ফেলার আতঙ্ক শুরু হয়েছে। সাবেক ও বর্তমান দু’ দুজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্যে থেকে এ দু’টো ক্ষতিকর প্রাণীর নাম উঠে এসেছে। একজন বলেছেন-‘উইপোকা যেন সরকারের উন্নয়ন খেয়ে না ফেলে’। আরেকজন বলেছেন ‘ইঁদুরের মত সরকারের উন্নয়ন খেয়ে ফেলছে বিএনপি’।

অর্থাৎ, ওনারা উইপোকা ও ইঁদুরের স্থলে এক শ্রেণির অন্ধকারের মানুষের কথা বোঝাতে চেয়েছেন। যারা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে বা নষ্ট করে উন্নয়নের সাফল্য ঘরে তুলতে দেয় না।

কিন্তু ওনারা যে ইঁদুর ও উইপোকার আক্রমণের আশঙ্কা করছেন তা চিহ্নিত করা খুব কঠিন। আসল উইপোকার দাঁত শক্ত, শরীর নরম। তাই ওদের দমনে ওষুধ বা বিষ ব্যবহার করা হলে পেট ফুটো হয়ে মৃত্যুবরণ করে। অথবা ইঁদুরকে প্রথমবার বিষছাড়া গন্ধবিহীন টোপ খেতে দিলে ওরা সহজেই খায়। এভাবে দু’একবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে একদিন আসল বিষটোপ ব্যবহার করে চালাক আসল ইঁদুরকে মেরে ফেলা সম্ভব। কিন্তু মানুষ সদৃশ ইঁদুর ও উইপোকার আক্রমণ ও সংক্রমণ বড়ই বিপজ্জনক। এদেরকে চেনা বড় দায়। এরা শয়তানের মত মানুষের রক্তশিরায় প্রবাহিত হতে পারে। এরা ভালমন্দের ধার ধারে না এবং বহুরূপী হয়ে বার বার নিজেদের রঙ বদলায়। মিথ্যা, ঘুষ, দুর্নীতি, মদ, জুয়া, পরকীয়া, ছলনা, খুন-খারাবি, ইভ-টিজিং, গ্যাং-দিয়ে চাঁদাবাজি ঘটানো এদের মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

এসব থেকে ‘আমরা পোকারা’ যে অর্থ উপার্জন করে তা যেহেতু অবৈধ এবং স্বাভাবিক পন্থায় প্রদর্শন করা যায় না সেহেতু এগুলো পাচার করা হয়ে থাকে। ক্যাসিনো, ঘুষ, চাঁদাবাজি, চুরি করা অর্থ কেউ স্বাভাবিক ব্যাংকে রাখতে পারে না। তাই এদের দ্বারা মানি লন্ডারিং ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অবৈধ হুন্ডি, অবৈধ কুরিয়ার ব্যবহার করা ছাড়াও কিছু বাস ড্রাইভার এদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে।

সংবাদে জানা গেল- ‘এমপিওভুক্তি হয়েছে জানার পর এক রাতেই কলেজ তৈরি।’ সম্প্রতি ২,৭৩০টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সেখানে ৬৫০টি স্কুল ও কলেজ এমপিও- অনুমোদন পেয়েছে। লবিং করে কিছু ভুঁইফোড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সরকারি অনুমোদন আদায় করে ফেলেছে। এটা তারই নমুনা।

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নতুনহাট এলাকায় একটি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের নতুন সাইনবোর্ড ও পাকা বিল্ডিংএর কাজ কলেজটি এমপিও ভুক্তি হয়েছে জানার পর একরাতেই করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এমপিওভুক্তির সরকারি অনুমোদন পাবার একদিনের মধ্যে এত দ্রুত কে অর্থ প্রদান করলো? দানবীর কেউ যদি বদান্যতায় গদগদ হয়ে কলেজ তৈরিতে অর্থলগ্নি করে ফেলেন তাহলে এতদিন সেটা করেননি কেন? এমপিওভুক্তির আগে দান করতে কি সমস্যা ছিল? এমপিওভুক্তির পর রাতারাতি এখন তার আগাম অর্থলগ্নি করার উদ্দেশ্য কি?

সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তা নিজেই এই ধরনের ভুঁইফোড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ব্যাপারে অবাক হয়েছেন বলে জানা গেছে।

অপরদিকে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট নিয়ে সাকিব আল হাসান মন্তব্য করেছেন- ’ঢাকা লিগে কোন খেলায় কে জিতবে তা আগেই জানে সবাই’! খেলাধুলার মত নিষ্পাপ বিনোদনের ক্ষেত্রেও যদি এ ধরনের অনৈতিক অবস্থার কথা শুনতে হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কেন সেই পাতানো খেলা দেখতে যাবে? এই ঘটনা আমাদের ক্রিকেটের চরম ভয়াবহ সংকটের বার্তা বহন করে বৈকি।

আসলে কিছু কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে রাজনীতি করতে গেলে চরম বিপর্যয় ছাড়া ভাল কিছুই আশা করা অমূলক। এখানে পক্ষপাতমূলক রাজনীতি থেকে অপরাজনীতি শুরু হয়েছে বলে মনে হয়। যা আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় মোবাইল ফোন নিয়ে হলে ঢোকা নিষেধ। সেদিন এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় কিছু তরুণ মিলে ডেস্ক খুলে পরীক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনসেট জমা রাখার জন্য ভলান্টিয়ারের কাজ করছিল। সেখানে ২০-৩০ জন পরীক্ষার্থী তাদের মোবাইল ফোনসেট জমা রেখেছিল। পরীক্ষা শেষে তারা এসে দেখে ডেস্ক নেই, ভলান্টিয়াররা উধাও! মোবাইলসেট ফেরত পাবার জন্য তারা হন্যে হয়ে ওদেরকে খুঁজে না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করতে থাকলো। জানা গেছে তারা ওদেরকে আর খুঁজে পায়নি। আমাদের যুব সমাজের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন কতটুকু নিচে নেমে গেছে তা এই ঘটনায় সহজেই অনুমেয়।

সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে ব্যাপক ধ্বস নেমে আমরা নৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছি। আমাদের তরুণ ‘আমরা পোকারা’ তাদের নিজ নিজ নৈতিক উন্নয়নের রশিকে আত্মস্থ করতে গিয়ে দ্বিধান্বিত। কারণ, বড় বড় মহারথীরা সেগুলোকে বহু আগেই কেটে কুটে দুর্গন্ধময় ছোবড়া বানিয়ে ফেলেছে। নতুনরা সেখানে শুধু পূতিগন্ধই খুঁজে পায়। তাই শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তরুণদেরকে লাঠিপেটা করে এর প্রতিকার করতে গেলে কোনো সুফল আসতে পারে না।

আমাদের তরুণ সমাজ পরিবার ও সমাজ থেকে সঠিক সময়ে সঠিক উপদেশ ও নৈতিক নির্দেশনা পাচ্ছে না। ফলে হঠাৎ অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ে ‘দুধের মাছি’ হবার শিক্ষা পাচ্ছে। অপরদিকে পরিবার ও সমাজের গণ্ডি ছেড়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসে দলীয় হীন রাজনৈতিক আবর্তে পড়ে সংকীর্ণমনা হয়ে উঠছে।সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, সহমর্মীতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদির কথা তারা বইয়ে পড়ে অথবা ক্লাসে শোনে। কিন্তু ক্লাসরুমের বাইরে গিয়ে অনৈতিক ও বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে তা বেমালুম ভুল যায়। তা না হলে আবরার হত্যাকাণ্ডের মত এমন নির্মমতা কেন ঘটবে?

এছাড়া বিষয় ভিত্তিক নিজ অপছন্দ ও অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভর্তি, কর্মহীন উচ্চশিক্ষা ও চারদিকে বেঁচে থাকার জন্য স্বার্থপর ভোগবাদী পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ চাকরিতে অজানা গন্তব্যের হতাশা একজন উঠতি তরুণ শিক্ষার্থীকে করে তুলছে খিটখিটে মেজাজসর্বস্ব বেপরোয়া মানুষে। যখন দেখা যায়- হলের পাশেই দামী রেস্টুরেন্টে বসে অন্যেরা (যাদেরকে ‘আমরা পোকা’ বলছি) লাঞ্চে বসে হাজার টাকা ব্যয় করছে, দামী জুতো, জিন্স পরে ঘুরছে, দামী মোবাইল ও নোটবুক ব্যবহার করছে, গলায় স্বর্ণের চেন-লকেট ঝুলিয়ে বড়লোকি দেখিয়ে অহংকার করছে, বিনা পরিশ্রমে ভাল ফলাফল করছে- তখন অজান্তেই মেধাবী লাজুক ছেলেটিও একদিন ওদের পাল্লায় পড়ে গড্ডালিকায় ভেসে যায়। তাকেও একদিন কাঁচা পয়সা অর্জনের লোভ পেয়ে বসে। এজন্য আমাদের অপরাজনীতি, অব্যবস্থাপনা ও সার্বিক কর্ম পরিবেশ কম দায়ী নয়। তাইতো এরা সিংহভাগ ক্ষেত্রে বিচ্যুত ধারার অপরাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে উন্নয়ন খেয়ে ফেলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যায়। তাই স্বভাবতই: এসব উইপোকার আক্রমণের আশঙ্কা থেকে সমাজে আতঙ্ক শুরু হয়েছে।

শুধু এদেরকে দোষ না দিয়ে এদের উস্কানিদাতাদের কু-নীতি বদলানোর কাজে হাত দিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে পারলে অচিরেই উইপোকাদের মধ্যে সু-নীতি ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ আজকাল সভ্য সমাজে হঠাৎ প্রতিকার নয়- পরিকল্পিত প্রতিরোধ সর্বজন স্বীকৃত। তাইতো আমরা আমজনতা সুদিনের অপেক্ষায় আছি।

 

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর