জাবি: ক্ষমতার লড়াইয়ে শিক্ষার বিপর্যয়!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-25 03:55:58

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সংকট দিনে দিনে ক্রনিক আকার ধারণ করেছে। পুরনো বা ক্রনিক রোগের মতো সমস্যাটি ডালপালা ছড়িয়ে 'পয়েন্ট অব নো রিটার্ন' পর্যায়ে চলে গেছে। ভিসি ও ভিসি-বিরোধীদের সর্বাত্মক মুখোমুখি অবস্থানের ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম।

আরও পড়ুন: https://barta24.com/details/campus/60336/protest-against-vc-at-ju 

গত কয়েক মাস ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা ও পক্ষে-বিপক্ষের আন্দোলন চলছে, তা ক্যাম্পাসবাসী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পুরো জাতির মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাবির সর্বশেষ পরিস্থিতিতে সবাই চরমভাবে উদ্বিগ্ন।

এমনিতেই দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের নিয়ে নানা কথা ও অভিযোগ রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরের চলমান ঘটনা সে অভিযোগগুলোকে আরও পোক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য করছে। উপাচার্যের পদটিও আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত হতে হতে অবক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন: https://barta24.com/details/debates/58796/ath:-vice-chancellor! 

জাবি প্রসঙ্গে বলা যায়, সেখানে অনেক দিন ধরেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি চলছে। এক দলকে নিয়ে উপাচার্য স্বপদে বহাল থাকতে মরিয়া। নানা কৌশল ও পদক্ষেপ চলছে এজন্য। অপর পক্ষ উপাচার্যকে মোটেও মেনে নিতে চাচ্ছে না। উভয় পক্ষ নানা কর্মসূচিতে মাঠে সরব। এসব কর্মসূচি চালাতে গিয়ে উভয় পক্ষের শিক্ষকদের সময় ও মেধা ব্যয় হচ্ছে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান যে কাজ, সেই শিক্ষা কার্যক্রমের হানি ঘটছে। বারোটা বাজছে পড়াশোনার।

https://barta24.com/details/campus/60181/the-strike-was-steady

বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়া এবং ক্ষমতাচর্চা করার বিধিবদ্ধ ফোরাম ও প্রক্রিয়া রয়েছে। জাবিতে মনে হচ্ছে, ফোরাম ও প্রক্রিয়ার অবসান ঘটেছে। সবাই যেভাবে নিজ দাবিতে মাঠে নেমে নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত, তাতে শিক্ষক সুলভ সংস্কৃতির নতুন বিন্যাস দেখা যাচ্ছে। অতীতেও উপাচার্যের বিরুদ্ধে জাবিতে আন্দোলন হয়েছে। এখনো তেমন আন্দোলন চলছে। অন্যান্য অনেক অভিধার সঙ্গে সঙ্গে একটি অতি-রাজনৈতিক ইমেজ জাবিকে আচ্ছন্ন করেছে। ম্লান হয়েছে শিক্ষার পরিবেশ, একাডেমিক মর্যাদা ও সম্মানজনক ভাবমূর্তি।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাবির গৌরবময় অতীত ও ঐতিহ্য রয়েছে। সাম্প্রতিক কার্যকলাপের জন্য সেসব চাপা পড়ছে। এক সময়ের স্বনামধন্য জাবি ক্যাম্পাসের এহেন অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? প্রতিষ্ঠানকে দিনে দিনে উজ্জ্বল করার বদলে কালিমালিপ্ত করছে কারা? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে হত্যা, নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, অসাধুতা ও দুর্নীতির একটি শক্তিশালী প্রবণতা তীব্র বেগে বাড়ছে। একাডেমিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত কাজের বদলে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের নানাবিধ অপতৎপরতা। সব শিক্ষক নয়, একদল লোভী, আত্মমুখী ও স্বার্থপর শিক্ষকের কারসাজিতে কলুষিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাঙ্গন।

আরও পড়ুন: https://barta24.com/details/campus/60483/ju-professor-accused-of-abusing-female-teacher 

মিডিয়ার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, দুর্নীতি, মতাদর্শিক অসাধুতাজনিত দলবদল ও চারিত্রিক স্খলনের দোষে দুষ্ট, অভিযুক্ত ও নিন্দিত 'শিক্ষকদের' এইসব সমস্যার পেছনে কলকাঠি নাড়তে দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতিকে নাজুক ও স্পর্শকাতর করে এই স্বার্থবাদী 'শিক্ষক গোষ্ঠী' দেশের শিক্ষাঙ্গনকে রক্তাক্ত ও নিজেদের লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের একটি নষ্ট ধারা দেশের বিভিন্ন লাভজনক সেক্টরের মতো উচ্চশিক্ষাঙ্গনেও চলছে।

নিজের স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়দের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়াই যাদের একমাত্র এজেন্ডা, তাদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের বিষয় ছাড়া উদার, মানবিক, প্রগতিশীল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বড় মাপের আচরণ আশা করাই বাতুলতা। জাবি এবং আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিক সংবাদে এমনই ব্যক্তিগত সুবিধাবাদী ইস্যুর কথা জানা যাচ্ছে এবং এসব ব্যক্তিগত, ফায়দা ও স্বার্থের দড়ি টানাটানির ফলেই আস্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট ঘনীভূত হওয়ার বিষয়টিও প্রতীয়মান হচ্ছে।

বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বড় গলদ হচ্ছে দ্বিধা, বিলম্ব ও প্যাসিভনেস। গলায় আটকালে বা দম বন্ধ হলে এদেশে সবার দৌড়ের শুরু হয়। তার আগে সংশ্লিষ্ট সবাই যেন তামাশা দেখে বা ঘটনা নানা খাতে বয়ে যেতে ইন্ধন দেয়। অবশেষে অবস্থার চরম অবনতি হলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তা সামাল দিতে হয়। বুয়েট এবং আরও অনেক সংকটে তেমনই হয়েছে।

জাবির ক্ষেত্রে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি যে সুবিধার নয় এবং সুখকর নয়, তা দিব্যি দেখা যাচ্ছে। বিদ্যমান জটিল, নাজুক ও অচল পরিস্থিতির জন্য কে বা কারা দায়ী, সেটাও নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ, পক্ষ ও বিপক্ষ থেকে উত্থাপিত পরস্পর বিরোধী অভিযোগগুলো গভীর ও মারাত্মক, তার আদ্যপান্ত কারণ অনুসন্ধান করা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তব্য। সরকারের বহু দক্ষ প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ আছে, যারা এ কাজে পারদর্শী।

জাবির বর্তমান সংঘর্ষমুখী ও শিক্ষার বিপর্যয়কারী পরিস্থিতির কার্যকারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সব বিভাগকে অতিদ্রুত কাজে নামতে হবে। আরও বড় কোনও সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগেই জাবির ক্ষমতার লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে ও শিক্ষার সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা অবশ্য কর্তব্য।

শিক্ষাঙ্গনকে অস্থিতিশীল ও অস্থির করার কাজে কোনও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইন্ধন থাকলে সেটাও দূর করা দরকার। প্রয়োজনে সমাজের অন্যান্য দুর্নীতিগ্রস্ত অংশের মতো ক্যাম্পাসগুলোতে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে জড়িতদের শাস্তি দিয়ে হলেও শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনও শৈথিল্য সমস্যাকে তীব্র করবে ও বিপদ বাড়াবে, যা জাতির জন্য চরম অকল্যাণকর হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম এবং অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর