এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি কোন পথে?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. তুহিন ওয়াদুদ | 2023-08-25 15:35:54

রংপুরের রাজনীতি মূলত দীর্ঘদিন আবর্তিত হয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কেন্দ্র করে। ১৯৯০ সালে দেশবাসীর তুমুল আন্দোনের মুখে নয় বছরের স্বৈরশাসনের সমাপ্তি ঘটে। একচ্ছত্র ক্ষমতাধর এই সামরিক শাসককে কারাগারেও যেতে হয়। তবে এই কারাবাস পরে তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। সারাদেশে প্রতিবাদী মানুষ যখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষমতাচ্যূত করার লড়াই সংগ্রাম করেছেন, সেই লড়াই সংগ্রাম রংপুরেও কম হয়নি। বরং, রংপুরের মাটিতে তার আসাটাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। এরশাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে রংপুরের মাটিও কম্পিত হয়েছিল।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। প্রায় নয় বছর ছিল তার শাসনকাল। এই নয় বছরে রংপুরের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করেননি তিনি। এ কারণে রংপুরে ভীষণভাবে ঘৃণিত ছিলেন এরশাদ। কিন্তু জেলবাসের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় নেতা। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সারাদেশে এরশাদের জাতীয় পার্টির ভরাডুবি হলেও রংপুর বিভাগের প্রায় সব আসনে লাঙল প্রতীকের জয়জয়কার ছিল।

বাংলাদেশে তো বটেই, সারা বিশ্বের কাছে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রমাণ করার সুযোগ পেলেন যে তার জনপ্রিয়তা আছে অনেকখানি। বলা যায়, তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর তথা আজকের রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টিরও সোনালী যুগ রচিত হয়। এরপর থেকে এখানে ক্ষয়িষ্ণু পার্টিতে পরিণত হতে থাকে জাতীয় পার্টি।

১৯৯০ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তারা রংপুর বিভাগের উন্নয়নে চরম উপেক্ষা দেখায়। ১৯৯৬ সালে দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটিতে বিএনপি গণমানুষ বিচ্ছিন্ন প্রহসনের নির্বাচন করে। গণমানুষের দাবির মুখে দেওয়া নতুন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। জাতীয় পার্টির অবস্থা তখন আরও ক্ষয়িষ্ণু। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁট বাঁধে। মহাজোট নাম নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে আসে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি ততদিনে অনেকখানি ক্ষয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের নৌকায় পথ চলতে শুরু করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি সেভাবে না থাকায় আওয়ামী লীগের নৌকায় লাঙল দিয়ে বৈতরণী পাড়ি দেয় জাতীয় পার্টি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও এককভাবে নির্বাচন না করে মহাজোটের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছে।

গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে আমরা লাঙলের যেটুকু জয় দেখি, বাস্তবে একক নির্বাচনে তাদের সেই সক্ষমতা নেই। একক প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করলে তাদের পক্ষে জয় পাওয়া খুবই কঠিন। উপজেলা নির্বাচনে সারাদেশের মতো রংপুর বিভাগে তাদের অবস্থা খুবই বেহাল। দুই/একটিতে জয় পেয়েছে মাত্র। ইউনিয়ন পরষিদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির অবস্থা তলানিতে।

তবে গত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লাঙল প্রতীক বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছে। গাইবান্ধা এবং কুড়িগ্রামের উলিপুরে উপ-নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করেছিল। এসব নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে জাতীয় পার্টির জয় পাওয়া সহজ ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি কোন গন্তব্যে পৌঁছবে, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন জনগণ।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন কারাগারে ছিলেন, তখন রংপুরের সাধারণ মানুষ সহানুভূতিশীল হয়ে ভোট দিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ভোট না দিলে তার ফাঁসিও হতে পারে। এসব কারণে তখন সাধারণ মানুষ লাঙলে ভোট দিয়েছেন। এখন তার মৃত্যুতে রংপুরের মানুষ লাঙলকে কীভাবে গ্রহণ করবেন, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনটি উন্মুক্ত থাকলে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা পরিমাপ করা যেত। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে রংপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজুকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই আসনটিকে মহাজোটের আসন হিসেবে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের আর কোনো প্রার্থী থাকল না। হুসেইন মুহম্মদ এরাশদের ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ এই আসনের মহাজোট প্রার্থী। আগামী ৫ অক্টোবর ২০১৯ রংপুরের এই আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এক সময় প্রমাণ হয়েছিল, রংপুর এরশাদের ঘাঁটি। সেই ঘাঁটি কিংবা দুর্গে ধস নেমেছে অনেক দিন। এখন আরও করুণ অবস্থায় আছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কেন্দ্র করেই জাতীয় পার্টি। নীতি-আদর্শ-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এমন কিছুই তারা সাধারণ মানুষের কাছে নিযে আসেননি, যা দেখে তাদের প্রতি মানুষ ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারে। তারপরও রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। এখন যারা দলে আছেন, তারা যদি নতুন স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কাছে আসতে পারেন, তাহলে জাতীয় পার্টি নতুন পথ খুঁজে নিতে পারবে। অতীতে ফিরতে পারবে। নয়তো ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

লেখক: ড. তুহিন ওয়াদুদ, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর