জীবন দিলাম, নিরাপদ সড়ক পেলাম না

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-29 06:32:30

হাত, পা, কান, জীবন, হারালাম তো সবই। তারপরও সড়ক নিরাপদ হবে না। এ বিষয়ে মনে হয়, এক ধরনের নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। যে আশা পূরণ হবার নয়। যে দাবি নিয়ে উন্নাসিকতা রাষ্ট্রের সকল যন্ত্রের। সেই দাবি এবং আশা মনে বেঁধে রেখে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং পরিবহন চালকের দয়ার ভরসায় পথে নেমে পড়া ভালো। তিনি বা তারা যদি আমাদের প্রাণ রক্ষা করেন, তবে বাড়ি ফিরে আসতে পারব। নাহলে পথ থেকেই অন্তিম যাত্রা।

দুর্ঘটনাবশত প্রাণ বেঁচে যেতে পারে কোনো অঙ্গের বিনিময়ে। যেমন পায়ের বিনিময়ে বেঁচে গেলেন বিআইডব্লিউটিসি’র কৃষ্ণা রায়। আমরা স্মরণ করতে পারি, নিকট অতীতে দুই বাসের চাপায় হাত হারিয়েছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গেছে গৃহবধূ আয়শা খাতুনের। গ্রীন লাইন বাস কেড়ে নিয়েছিল রাসেল সরকারের পা।

জীবন হারানোর ঘটনা তো রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে। প্রতি মুহূর্তে ঘটছে বলাও মনে হয় এখন অতিকথন হবে না। এবারের ঈদ উৎসবেও সড়ক পথে আমরা মৃত্যুর মিছিল দেখতে পাই। বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারাদেশের শিক্ষার্থীরা যখন প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে সড়কে নেমেছিল, তখন তাদের ফেরানোর জন্য কতো চোখ রাঙানি দেখেছি।

আইন, নীতিমালা, টাস্কফোর্সও কম হয়নি। কোনো কোনো অঙ্গহানী ও মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ নিয়ে আদালতের কঠোর নির্দেশনাও এসেছে। কিন্তু সড়ককে নিরাপদ করা যায়নি। প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের প্রাণ যাচ্ছে সড়কে।

সড়কে প্রাণ ঝরছে কেন? শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া উচিত পথচারীদের অসচেতনতা এর জন্য দায়ী। কিশোররা যখন নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নেমেছিল, তখনও আমরা দেখেছি, পথচারীদের আইন মানাতে তাদের কতো বেগ পেতে হয়েছে। কিশোর-কিশোরীরা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার পর আবার তারা বেপরোয়া। ফুটওভার সেতু রেখে যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছে। এই ফুটওভার ব্রিজ যথাযথভাবে ও জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

মহাসড়কের পাশে সার্ভিস লেন না থাকায় কম গতির বিচিত্র পরিবহন চলাচল বন্ধ করা যায়নি। মহাসড়কের পাশে বাজার-হাট চলমান থাকায় রাস্তা পারাপারে দুর্ঘটনা বাড়ছেই। কমগতির ফিটনেসবিহীন গাড়িও দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ। ওভারটেক বন্ধ করা যায়নি।

চালকদের মধ্যে মাদকসেবনের প্রবণতা বাড়ছেই। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে উঠেছে চালকদের মাদকাসক্তি। ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতির ত্রুটি সারানো যায়নি। লাঠি-বাঁশ–দড়ি দিয়ে চলছে ট্রাফিক সিগন্যাল।

ঢাকার রাস্তায় পরিবহনগুলোকে নির্দিষ্ট লেন ব্যবহারে বাধ্য করা যায়নি। সড়কে, মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে অবাধে। চালকদের খুব কম অংশই বৈধ লাইসেন্সের ধারক। মহাসড়কে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় পরিবহনের বেপরোয়া গতি কমানো যায়নি।

এই যখন বাস্তবতা, তখন কীভাবে আমরা নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন বুনে রাখবো? সড়কে আধিপত্য এখনো পরিবহন শ্রমিক মালিকদের। স্বয়ং সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারে না। কোনো আইন তৈরির কথা বললে, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেই চলে আসে ধর্মঘটের হুমকি। কোনো কারণ ছাড়াই পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দেবার মতো ঘটনাও দেখেছি আমরা।

এই আধিপত্যবাদের পেছনে কাজ করে রাজনীতি। কোনো নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দল নয়, সকল রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতায় থাকাকালীন পরিবহন-মালিক শ্রমিকদের কাছে অসহায় দেখতে পেয়েছি আমরা। কারণ যে শুধু রাষ্ট্র অচল করে দেবার হুমকি তা নয়, এতো বড় পেশাজীবী শ্রেণীকে পাশে রাখার লোভটাই এখানে বড় কারণ। এই লোভ সংবরণ না করা পর্যন্ত সড়কে নিরাপদ বাতি জ্বলে ওঠার স্বপ্ন না দেখাই ভালো।

তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর