‘মাথা লাগা’ গুজব ও দৃশ্যমান পদ্মা সেতু

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মো. হাসেন আলী | 2023-08-31 19:27:04

পদ্মা সেতুতে ‘মাথা লাগবে’-এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। মহল বিশেষ থেকে প্রচার করা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর সময় পশু বলি দেওয়া হ‌য়ে‌ছিল। দু’টি কা‌লো ষাঁড়, দু’টি খাসি, দু’টি মোরগ। প‌রে এদের রক্ত নদী‌তে ঢে‌লে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব, স্কুলছাত্র গ্রেফতার

কুসংস্কার পৃথিবীতে নানাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু আলোকিত মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না।

উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা যেতে পারে। যেমন, ভুতে ধরা, ফুঁ দিয়ে সাপের বিষ নামানো ইত্যাদি। তবে আমি আবার বলি, প্রকৃত অর্থে বিশ্বাসের অবশ্যই একটা ভিত্তি আছে এবং বিশ্বাসের প্রভাব মারাত্মক। যেমন, কাউকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখে যদি তার সামনে একটা গোখরা সাপ রেখে দেওয়া হয়, আর এরপর যদি রশি দিয়ে বেধে রাখা ব্যক্তিটিকে গোখরা সাপটি দেখিয়ে চোখ বেঁধে দেওয়া হয়, তারপর, চোখ বাঁধা অবস্থায় তার পায়ে যদি একটা আলপিনের গুতো দেওয়া হয় এবং পরে তাকে যদি বিশ্বাস করানো হয় যে, তাকে গোখরা সাপে কামড়িয়েছে, তবে ওই ব্যক্তি আলপিনের গুতোকেই সাপের কামড় বলে বিশ্বাস করবে। আর দুর্বল চিত্তের লোক হলে আতঙ্কিত হয়েই মারা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব, আটক ৪

আরেকটি তথ্যও দেওয়া যায়। যেমন, বাংলাদেশের অধিকাংশ সাপে বিষ নেই। কিন্তু যে সাপে বিষ নেই সে সাপে কামড়ালেও মানুষ আতঙ্কিত হয়ে মারা যায়। এখান থেকে বোঝা যায় যে বিশ্বাসের শক্তি অনেক। বিশ্বাসের ভিত্তিতে ক্ষতি হতে পারে, মুক্তিও আসতে পারে, জ্যোতি বা আলোকপ্রাপ্তিও ঘটতে পারে।

বিশ্বাস কীভাবে গুরু মস্তিষ্ক ও লঘু মস্তিষ্কে কাজ করে, তা নিয়ে নিউরোসাইন্স ও মেটা সাইকোলজি সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারে। সেতুর জন্য মাথা লাগবে কিংবা অন্য যে কোনো কুসংস্কারই বিপজ্জনক। বিশ্বাসের নামে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হলে নানা বিপত্তি ঘটে।

অতএব, পদ্মা সেতুর কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে মানুষের মাথা চাইতে পারে এটা অকল্পনীয় হলেও ভুল বিশ্বাস বা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে তা গ্রহণ করাও মানসিক বৈকল্যের লক্ষণ। বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকদের উচিত সমাজে বা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে এমন ভুল বিশ্বাস কাজ করে কিনা তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা এবং মানুষের বিভ্রান্তি দূর করা।

বৃহত্তর সমাজেও আমাদের নজর দিতে হবে। জীবন বাঁচাতে হবে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু ও নারীরা যে গ্রাম-বাংলায় ভুল বিশ্বাসের তাণ্ডবে প্রাণ ও সম্ভ্রম হারান, এমন খবরও প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়। কারণ, প্রাচীনকাল থেকেই তো মানুষ কতই না নিষ্ঠুর প্রথা-লোকাচার পালন করে আসছে, যা কালচারাল এন্থ্রোপোলজি অধ্যয়ন করলে জানা যায়।

গলা কাটার বিষয়টা বুঝতে হলে অনুধাবন করতে হবে, মানুষ যখন কোনো নির্বোধকে পায়, তখন তাকে এমন অলৌকিক পন্থায় কিছু বলে যে নির্বোধ ব্যক্তি ভয় পেয়ে যায়। আজগুবি কিছু শুনলে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি কোনও কিছু শুনলে বা জানলে পরীক্ষা করে। তার সমাজ কাঠামো, রাজনৈতিক কাঠামো, অর্থনৈতিক কাঠামোতে সেই কথার সত্যাসত্য অন্বেষণ করে।

আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আর এ জন্য কুচক্রীমহল সহ্য করতে না পেরে মানুষের মাথা লাগবে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সেজন্য প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে- ‘মাথা লাগবে’ এই গুজব বন্ধ করার জন্য আদেশপত্র জারি করা হয়েছে। আমাদের মত অশিক্ষিত দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত এসব গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। যা মোটেও কাম্য নয়।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু নিয়ে অপপ্রচারের কোনো সত্যতা নেই

মনে রাখা ভালো যে আমাদের দেশপ্রেমিক কর্মকর্তারা অর্থাৎ প্রকল্পের সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, তারা অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছেন। এটা দৃশ্যমান সত্য এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য। এখানে অন্য কোনো গুজব খোঁজার প্রয়োজন নেই।

মো. হাসেন আলী; দর্শন ও মরমীবাদ বিষয়ক গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর