আত্মহত্যা রোধে প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ | 2023-08-26 12:38:54

সমাজের কিছু ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। বিশেষত কেউ যখন চরম অভিমানে স্বেচ্ছায় আত্মজীবন ত্যাগ করে। দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত কারণে মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু আত্মহননের মৃত্যুতে সমাজের মানুষ ব্যথিত হয় চরমভাবে। বর্তমান সময়ে দেশে বেড়েই চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকা, টিভি-চ্যানেল ও ফেসবুকে ভেসে ওঠে আত্মহননের করুণ চিত্র।

আমার বাসা চট্টগ্রাম শহরের উত্তর আগ্রাবাদ এলাকায়। গত মাস দু'এক আগে বাসা থেকে বের হওয়ার পথে দেখি বাসার সামনে এক ভবনের কাছে ভীড়। ভবনের ফটকের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার মেয়ের গৃহ শিক্ষিকাকে। আমাকে দেখেই ইতস্থত হলেন। কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, তার ভাই আত্মহত্যা করেছে। বিষণ্ন মনে ভাবলাম, ২৫ বছরের এ যুবক কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেল?

রাজধানীর ভিকারুননিছা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী অরিত্রির আত্মহননে কেঁদেছে সমগ্র দেশ। অরিত্রি পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অসদুপায় অবলম্বন করেছে। মেয়ের অপরাধের জন্য শিক্ষকদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন বাবা। কিন্তু প্রচণ্ডভাবে তিরস্কৃত হলেন তিনি। অরিত্রি বাবার অপমান সইতে পারেনি। সে তার বাবার অপমানের প্রতিবাদ জানালেন ভিন্নভাবে-আত্মহননের মাধ্যমে।

আমার প্রথম কর্মস্থল ছিল বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা। ডা. ইসমাইল নামের এক স্থানীয় নেতার সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হয়। একটা পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। বছর খানেক আগে কক্সবাজারের এক হোটেলে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তার লাশ। তার রহস্যময় আত্মহননে আমি আজও ব্যথিত। কিন্তু কেন এ আত্মহনন?

আত্মহত্যা বা Suicide কী? আত্মহত্যা হলো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে ধংস করা বা হত্যা করা। ইংরেজি Suicide এর Sui অর্থ Self এবং Cide অর্থ killing। নিজেকে হত্যা করার মত অস্বাভাবিক কাজটিই হলো আত্মহত্যা। এটি সামাজিক একটি ব্যাধি। চিকিৎসাশাস্ত্রে আত্মহত্যা মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত। এ সমস্যা নিরসনে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

প্রখ্যাত মনঃসমীক্ষণবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের প্রবৃত্তি দুরকম। ১. জীবন প্রবৃত্তি বা Life Instinct। এক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে আত্মরক্ষা ও বংশবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষণীয়। ২. মৃত্যু প্রবৃত্তি বা Death Instinct। এক্ষেত্রে মানুষ অন্যকে হত্যা ও আত্মহত্যায় উদ্যত হয়।

বেঁচে থাকা মানুষের সহজাত প্রবণতা। ব্যক্তিগত সামঞ্জস্যতা ও ব্যক্তিত্বের পূর্ণবিকাশের অক্ষমতার কারণে মানুষ অসহায় বোধ করে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের ব্যর্থতায় মানুষ আত্মমর্যাদার সংকটে ভোগে। প্রচণ্ড মানসিক চাপে মানুষ ভারসাম্য হারিয়ে নিজেকে আড়াল করার অন্ধকার পথ খোঁজে। আত্মহত্যা যদিও একান্ত ব্যক্তিগত ধ্বংস সাধন, তারপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবারের সদস্য, গোটা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা সবার উপর।

প্রতিদিন দেশের প্রায় ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। সমাজের প্রতি প্রচণ্ড ধিক্কার, অভিমান, অপমান ও হতাশা নিয়ে তাদের এ নিরব প্রস্থান। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটছে প্রতিনিয়ত। দেশে বহুমুখী সামাজিক সংকট বিরাজমান, যেমন: মাদকাসক্তি, কর্মসংস্থান সংকট, পারিবারিক কলহ, ভালবাসায় ব্যর্থতা, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, বেকারত্ব, যৌন নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, পরকীয়া, প্রিয়জন হারানো, ভিন্নধর্মাবলম্বীকে বিবাহ, ক্যারিয়ার নিয়ে সন্দিহান ইত্যাদি। এতোসব সমস্যার মাঝে ব্যাক্তির পক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিশোর-কিশোরী আদর্শচ্যুত হচ্ছে। তারা হারাচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ। ফলে এ পরিণতি হিসেবে অনেকে আত্মহননের পথে ধাবিত হয়।

আত্মহনন প্রবণতায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। গত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বের মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে ১১ হাজার ৯৫ জন। বিশ্বে প্রতি বছর ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বে একজন লোক আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। আত্মহত্যা প্রবণতা মানসিক একটি রোগ বিশেষ। এ প্রকৃতির মানুষ প্রচণ্ড আবেগ প্রবণ এবং তারা বিষন্নতায় ভোগে। কিন্তু জনসংখ্যাবহুল এ দেশে মানসিক সংকট মোকাবিলায় চিকিৎসক সংখ্যা মাত্র ২০০ জন। দেশের মাত্র ২২ হাসপাতালে মানসিক রোগীর চিকিৎসা চলে।

সম্প্রতি আত্মহত্যা একটি সামাজিক সমস্যা হিসেব দেখা দিয়েছে। সামাজিক সমস্যার বিরূপ প্রভাব পড়ে সমাজের সবার ওপর। মানুষ বিভিন্ন কারণে মর্যাদা সংকটে পড়ে। তখন পথ খোঁজে নিজেকে স্থায়ীভাবে আড়াল করার। আত্মহত্যার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় গুটিয়ে ফেলতে চায় নিজেকে। পারিবারিক সহনশীলতা ও সামাজিক সচেতনতা মানুষের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনে।

মানুষ জগৎশ্রেষ্ঠ ও বিবেকবোধ সম্পন্ন প্রাণী। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয় মানুষের কাজের মাধ্যমে। চলমান সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় সমাজের সব সক্রিয় সদস্যদের ভূমিকা পালন করতে হবে। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে সবাইকে। তাদের প্রতি হতে হবে সহমর্মী ও সমব্যাথী। ব্যক্তির সামাজিক সুরক্ষায় পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীসহ সকল সামাজিক সদস্যের ভূমিকা হতে হবে ইতিবাচক। যারা হতাশাগ্রস্ত, যারা বিষণ্নতায় ভোগে ও নিজেকে পরাজিত মনে করে, তারা হারিয়ে ফেলে বেঁচে থাকার সাধ। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষরা আমাদেরই আপনজন। এ ধরনের সমস্যাগ্রস্ত মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও উত্তেজনা উপশমে সচেষ্ট হতে হবে সবাইকে। সমাজের ভাগ্যবিড়ম্বিত আত্মনিয়ন্ত্রণহীন মানুষদের চিহ্নিত করে তাদেরকে প্রয়োজনীয় মানসিক সুরক্ষা দিতে হবে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও সৃজনশীলতা স্রষ্টা প্রদত্ত মানুষের এক অনন্য শক্তি। এ শক্তির বিকাশ সাধন করতে হবে। মানুষের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে হবে। আর নয় আত্মহত্যা। আর নয় বিনাশ।

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ: সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর