ফেনী থেকে কিশোরগঞ্জ: ধর্ষণ-নারীহত্যা থামছেই না!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-27 04:29:51

প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে ফেনীর মাদরাসাছাত্রীকে যৌন নিপীড়িন ও পুড়িয়ে হত্যা করার অপরাধীরা আইনের আওতায় এলেও ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নারীহত্যা কমেনি। কিশোরগঞ্জে চলন্তবাসে একজন নার্সকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

ফেনীর মতোই নির্যাতন শেষে কিশোরগঞ্জেও নারীহত্যা করেছে ধর্ষকরা। এমনকি, তার মরদেহ গাড়ি থেকে আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে বাসের যাত্রী নার্সকে হত্যার সময়টি ছিল চমৎকার! সদ্য রমজানের চাঁদ উঠেছে এবং তারাবির নামাজ শুরু হয়েছে। তেমন একটি পবিত্র সময়ে বাসের ড্রাইভার, হেলপার ও সহযোগীরা যাত্রীকে নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে পশুর মতো খুঁবলে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। নীতি, নৈতিকতা, মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা করে ধর্ষণ শেষে আক্রান্ত নারীকে হত্যা করে চলন্ত গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়।

কষ্টকর হলেও প্রেক্ষাপট ও ধর্ষকদের মানসিকতার বাস্তবচিত্র আমাদের সামনে রাখা দরকার। এটাও দেখা দরকার যে, মানবিক মুখের বদলে আমাদের চারপাশে কেমন পাশবিক মুখ কিলবিল করছে!

এই ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকগুলোর হাতে যখন বাসের স্টিয়ারিং ও পরিচালনার ভার থাকে, তখন দুর্ঘটনা কিংবা মানুষচাপা দেওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়। দেশে এখন তেমনই হচ্ছে। মানুষ মরছে চাকার নিচে কিংবা চালক-হেলপারের কাম ও ক্রোধের আগুনে।

কিশোরগঞ্জের নার্স ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে এমন একজনের এলাকায়, যিনি একদা পুলিশের আইজি ছিলেন। তিনি এখন যে এলাকার সংসদ সদস্য, সেখানে এই পাশবিক নারী নির্যাতন ও নারীহত্যা সংগঠিত হয়েছে। অতএব, সংসদ সদস্য তার অতীত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতায় দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন বলে সবাই আশা করছেন।

ফেনী ও কিশোরগঞ্জ কিংবা দেশের অন্যান্য স্থানের নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও নারীহত্যার উপযুক্ত বিচার হওয়ার পরেও অনেক প্রশ্ন থাকছে। তা হলো, ধর্ষণ-নারীহত্যার বিস্তার বাড়ছে কেন? কঠোর পদক্ষেপেও মানুষের পাশবিকতাকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? কেন সুযোগ পেলেই নারী, শিশু, অবলা ও দুর্বলের উপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুর্বৃত্তরা? কোনো কিছুর ভয়ই থামাতে পারছে না অপরাধীর অপকর্মের উদগ্র বাসনাকে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার!

কেন অপরাধ, বিশেষত নারীহত্যা ও ধর্ষণ বাড়ছে তা অপরাধ বিজ্ঞানীদের খতিয়ে দেখতে হবে। আইনের দুর্বলতা থাকলে আইন সংস্কার করে তা সবল করতে হবে। অপরাধের পরিধি যেমন দিনে দিনে বাড়ছে, আইনের পরিধিও তেমনিভাবে বাড়াতে হবে।

ধর্ষণের বিস্তার থামছে না/ ছবি:সংগৃহীত

বিশেষত তাত্ত্বিক আইন ও এর ব্যবহারিক প্রয়োগের সম্পর্কটি পরীক্ষা করতে হবে। শত শত ধর্ষণ, নারীহত্যা, নারী নির্যাতনের মামলায় যদি সিংহভাগ অপরাধী খালাস পেয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকে, তাহলে বাস্তব অবস্থার চিত্রটি বোঝা যায়। আইনের তাত্ত্বিক শক্তি আর বাস্তব দুর্বলতার জায়গাটুকু ভরাট করতে না পারলে অপরাধীদের পক্ষে ফাঁক গলে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে। এবং এর ফলে অপরাধ চলতেই থাকবে।

আইন মন্ত্রণালয়, আইন কমিশন, আইনের শিক্ষক-অধ্যাপক এবং আইনজীবী সম্প্রদায়ের সাহসী ও নীতিবান অংশের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব আসা দরকার। আইনের ফাঁক চিনব, ফাঁক বন্ধ করার সততা দেখাব না, এটা হতে পারে না। ধর্ষক, অপরাধীদের নিন্দা ও শাস্তি দাবি করব কিন্তু তাদের অপকর্ম রোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে সরব হব না, এটা তো প্রবঞ্চনা।

আমাদের প্রবঞ্চনাতেই অপরাধ বিস্তৃত হচ্ছে। আমরা এক মুখে নিন্দা জানাই ও শাস্তি দাবি করি, আরেক মুখ বন্ধ করে রাখি। আইনের সংস্কার ও অপরাধীর শাস্তি বিধানের পক্ষে কথা বলি না। ফলে পুরো বিষয়টিই প্রহসনে পরিণত হয়েছে। নিন্দা ও প্রতিবাদের মৌখিক চিৎকারের পরেও ধর্ষণ-নারীহত্যা চলছেই।

অতএব, নিন্দা ও প্রতিবাদের নামে লোক দেখানো চেঁচানোর বদলে কাজের কাজ করার ব্যাপারেই পদক্ষেপ নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। নইলে ফেনীর মাদরাসা, কিশোরগঞ্জের চলন্ত বাস হয়ে বিপদ আপনার ঘরেও ঢুকে যাবে। ‘অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না’, কিংবা, ‘নগরে আগুন লাগলে যেমন দেবালয় রক্ষা পায় না’, তেমনি ধর্ষণ ও নারীহত্যার মচ্ছবে অন্ধের মতো নিশ্চুপ ও প্যাসিভ হয়ে থাকলে রক্ষা পাওয়া যাবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর