চিরদিনের সিএমএলএ এরশাদ!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-31 13:48:07

আমার জন্মের সময়ও দেশে সামরিক শাসন ছিল। তবে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন পোক্ত হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আর সামরিক শাসন বোঝার বয়স তখনও হয়নি। তবে ছেলেবেলায় এই স্বাধীন দেশেই দু’টি সামরিক শাসন দেখেছি।

সামরিক শাসন এলেই বদলে যায় প্রশাসকের নাম। এমনিতে আমরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিদের কথা শুনি। কিন্তু দেশে সামরিক শাসন থাকলে একটা পদের নামই শোনা যায়- প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মানে চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর; সংক্ষেপে সিএমএলএ। ছেলেবেলায় আমরা দু’জন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সিএমএলএ দেখেছি। একজন জিয়াউর রহমান, তাকে অসুসরণ করে এইচ এম এরশাদ। সিএমএলএ হিসেবে ক্ষমতায় এলেও দু’জনই শেষ করেছেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। অবশ্য এরশাদের আমলে সিএমএলএ শব্দের দু’টি মানে ছিল। একটি চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, অপরটি ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট।

৩০ বছর আগে ক্ষমতাচ্যুত হলেও এরশাদ এখনও সিএমএলএ। ক্ষমতায় থাকতে যেমন, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও তিনি সিএমএলএ- ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট। সর্বশেষ ছোট ভাই জি এম কাদেরকে নিয়ে যা করেছেন, তাতে এটা প্রমাণিত, তিনি বাংলাদেশের চিরকালীন সিএমএলএ।

৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর গত ১৬ জানুয়ারি সাংগঠনিক এক আদেশে এরশাদ বলেছিলেন, তার অবর্তমানে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। এরশাদের এই সাংগঠনিক আদেশের পর জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতিতে দারুণ উত্থান ঘটে জি এম কাদেরের। তাকে ভবিষ্যতে পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করারও নির্দেশ দেন এরশাদ। করা হয় সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা। এসব নির্দেশের পর পার্টিতে এরশাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রওশন এরশাদপন্থীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। ভদ্রলোক জি এম কাদের বরাবরই পার্টিতে এরশাদের প্রতি অনুগত। এরশাদের নির্দেশ মেনে ২০১৪ সালের নির্বাচনেই অংশ নেননি তিনি।

কিন্তু জি এম কাদেরের ক্ষমতাকাল দীর্ঘ হতে পারেনি। গত ২২ মার্চ হঠাৎ আরেক সাংগঠনিক আদেশে এরশাদ ছোট ভাই জি এম কাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। প্রথম সরিয়ে দেন কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে। তার অবর্তমানে বা বিদেশে থাকার সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের নির্দেশনাও তুলে নেওয়া হয়। পরদিন সরিয়ে দেয়া হয় বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকেও। সেখানে বসানো হয় সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদকে।

জি এম কাদেরকে সরানোর কারণ হিসেবে সাংগঠনিক আদেশে বলা হয়, 'জি এম কাদের পার্টি পরিচালনা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। বর্তমানে পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে এবং পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। পার্টির সিনিয়র নেতারাও তার নেতৃত্বে সংগঠন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।’

কিন্তু নাটক এখানেই শেষ নয়। অব্যাহতি দেওয়ার ১২ দিনের মাথায় (৪ এপ্রিল) জি এম কাদেরকে আবার পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহাল করেন এরশাদ। বৃহস্পতিবার রাতে এক ‘সাংগঠনিক নির্দেশে’ জি এম কাদেরকে পুনর্বহাল করেন জাপার চেয়ারম্যান এরশাদ। এর একদিন পরেই (৫ এপ্রিল) তার অবর্তমানে বা বিদেশে থাকার সময় জি এম কাদেরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের আদেশও পুনর্বহাল করেন। এর আগে ১৮ জানুয়ারি জিএম কাদেরকে এক সাংগঠনিক আদেশে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন এরশাদ।

হা হা হা। একে নাটক বললে কম বলা হবে, এ হলো প্রহসন, এ হলো যাত্রাপালা। এই প্রথম নয়, এরশাদ যখন ইচ্ছা যাকে তাকে মাথায় তোলেন, আবার ছুড়ে ফেলেন। সবকিছুর জন্য এক কলমের খোঁচাই যথেষ্ট। মজাটা সব সাংগঠনিক আদেশেই জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ /১-ক ধারার কথা উল্লেখ করা হয়। এই ধারায় কী লেখা আছে তা জানি না। তবে নিশ্চয়ই সেখানে এরশাদকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া আছে। এরশাদ ক্ষমতায় থাকতেও স্বৈরাচার ছিলেন, এখনও তাই আছেন।

তবে সিএমএলএ হিসেবে এরশাদের পরবর্তী ঘোষণা কবে আসবে, তার জন্য আশা করি খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর