সময়ের পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ

, যুক্তিতর্ক

সায়েম খান | 2024-04-15 13:53:26

সপ্তম শতাব্দীতে গৌড় সাম্রাজ্যের সার্বভৌম নৃপতি ও বাংলা অঞ্চলে একীভূত রাষ্ট্রের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা ছিলেন রাজা শশাঙ্ক। রাজা শশাঙ্ক ছিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ভূবনেশ্বর পর্যন্ত একচ্ছত্র অধিপতি। তাকে অনেক ইতিহাসবিদ 'গৌড়াধিপতি'ও বলে থাকেন। আজ থেকে একহাজার ৪শ বছর আগে রাজা শশাঙ্কের শাষণামলে তার রাজ্যাভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে সৌরপঞ্জিকার ভিত্তিতে তিনি বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে এই রাজ্যাভিষেককে ঘিরে নানা উৎসব ও আয়োজনের মাধ্যমে প্রজাদের নিয়ে এই দিনটি উদযাপন করতেন বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্ক। এজন্য বাংলা নববর্ষের ১২ মাসের নাম নক্ষত্রের নামানুসারে রাখা হয়। 'বিশাখা' নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, 'জায়ীস্থা' থেকে জ্যৈষ্ঠ, 'শার' থেকে আষাঢ়, 'শ্রাবণী' থেকে শ্রাবণ, 'ভদ্রপদ' থেকে ভাদ্র, 'আশ্বায়িনী' থেকে আশ্বিন, 'কার্তিকা' থেকে কার্তিক, 'আগ্রায়হণ' থেকে অগ্রহায়ণ, 'পউস্যা' থেকে পৌষ, 'ফাল্গুনী' থেকে ফাল্গুন এবং 'চিত্রা' নক্ষত্র থেকে চৈত্র, এমন করেই নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়।

কালের বিবর্তনে সেই বঙ্গাব্দ হয়ে যায় ইতিহাস। ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে শুরু হয় মোগলদের শাসনামল। মোগলদের শাসনামলে চন্দ্রপঞ্জিকার ভিত্তিতে আরবি মাস গণনার মাধ্যমে "তারিখ-এ-এলাহী" হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রচলন ঘটানো হয়। "তারিখ-এ-এলাহীর" ১২ মাসের নাম ছিল 'কার্বাদিন', 'আর্দি', 'বিসুয়া', 'কোর্দাদ', 'তীর', 'আমার্দাদ', 'শাহরিয়ার', 'আবান', 'আজুর', 'বাহাম' ও 'ইস্কান্দার মিজ'।

মাসের এই শব্দগুলো আসলে আরবি ও ফার্সি শব্দ থেকে উদ্ভুত। কিন্তু মোগলদের ও প্রজাদের সমস্যা তৈরি হয় কর আদায়ের ক্ষেত্রে। মোগলদের শাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতবর্ষের ভূমি ও কৃষি কর আদায়ের ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষ বা 'হিজরি' সালকে অনুসরণ করা হতো। কৃষকেরা চাষাবাদ করতেন সৌরবর্ষের ভিত্তিতে আর মোগলদের শাসন ব্যবস্থা ভূমি ও কৃষিকর আদায় করতেন চন্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে।

চন্দ্রবর্ষ অনুসরণ করলে কর আদায়ের সময় কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করা যেতো না। কারণ, হিজরি বর্ষের শুরুতে প্রজা সাধারণের কাছে অর্থের অভাব থাকতো। কিন্তু কৃষকেরা নবান্নে ফসল ঘরে তোলার পর বঙ্গাব্দের শুরুতে তাদের কাছে অর্থের জোগান থাকে। সেই ক্ষেত্রে তারা ন্যায্য কর প্রদানে বাধাগ্রস্ত হয় না। এহেন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সম্রাট আকবরের দরবারে ডাক পড়ে মোগল সাম্রাজ্যের সেই সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি'র।

সম্রাটের আদেশে তাকে এই সমস্যার সমাধান করতে বলা হয়। ফতেহউল্লাহ সিরাজি তখন সৌরবর্ষ (বঙ্গাব্দ) ও হিজরি বর্ষকে একীভূত করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই বছরের নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ থেকে বাংলা সন করা হয়। বাংলা সনের শুরুর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিনে জনসাধারণ কর প্রদান করতে আসতেন রাজ দরবারে। সম্রাট আকবরের পক্ষ থেকে তাদের মিষ্টি বিতরণ করা হতো ও প্রজাদের চিত্ত বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

মোগল সম্রাট আকবরের প্রজাকর আদায়ের এই দিবস সময়ের পরিক্রমায় বাংলা সনের প্রথম দিন 'পহেলা বৈশাখ' হিসেবে রূপান্তরিত হয় বাঙালি সভ্যতার ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাগরিত হয় এই উৎসব। বাংলা বর্ষবরণের এই মহোৎসব উদযাপিত হয়, গোটা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। যদিও পহেলা বৈশাখ পালন নিয়ে এখনও কিছু বিভেদ আমরা লক্ষ করি। হিন্দু সম্প্রদায়ের তিথি পঞ্জিকা অনুসারে, পহেলা বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গে পালিত হয় ১৫ এপ্রিল। আর বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির নির্দেশনা অনুযায়ী, গ্রেগরিয় পঞ্জিকা অনুসারে পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ১৪ এপ্রিল।

পহেলা বৈশাখ মূল: প্রাচীন হিন্দু নববর্ষ উৎসবের সাথে সম্পর্কযুক্ত যা সনাতন ধর্মের বিক্রমী দিনপঞ্জির সাথে মিল আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে রাজা বিক্রমাদিত্য বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাব করেন বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। যদিও বিক্রমাদিত্যের বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাব নিয়ে অনেক ইতিহাসবিদ দ্বিমত পোষণ করেন।

প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মাঝে বাংলা নববর্ষ পালনের রীতি পরিলক্ষিত হয়। ভারতের আসাম রাজ্যে অসমীয়রা "রঙালি বিহু "উৎসবে মেতে ওঠেন বর্ষবরণের শুরুর এই দিনে। 'বিহু' অসমীয়দের ফসল কেটে ঘরে তোলার পর আনন্দে মেতে ওঠার একটি উৎসব যা বাংলা নববর্ষেরই অনুরূপ। ঠিক তেমনইভাবে ভারতের শিখধর্মের লোকেরাও "বৈশাখী" নামে পহেলা বৈশাখের দিনে উৎসব উদযাপন করেন। একইভাবে থাইল্যান্ডেও "ফ্যাসটিভাল অব ওয়াটার" বা পানি উৎসব নামে বর্ষবরণ উদযাপিত হয়, যাকে থাই ভাষায় বলা হয়ে থাকে 'সংক্রান'। পানি উৎসব দিয়ে বছর শুরুর দিনটি উদযাপনের চিত্র আমরা দেখতে পাই, আমাদের দেশের কিছু প্রাচীন নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের মাঝে।

আধুনিককালে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়, ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পূজা অর্চনার মাধ্যমে। একবিংশ শতাব্দীতে নববর্ষ উদযাপনে আমরা দেখতে পাই, এক বাণিজ্যিক ধারার রূপ। বহু প্রাচীন এই উৎসবের ধারায় নেই আগের মতো কোনো স্বকীয়তা। কর্পোরেট কালচার ও পুঁজিবাদের চাপে জৌলুসময় পহেলা বৈশাখ যেন ব্যবসায়িক ফায়দার একটি পন্থা বৈ আর কিছুই নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একত্রে মিলে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মাধ্যমে নতুন দিনের ও নতুন বছরের সূচনা হোক এক সুখময় আবেশে।

সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর