রিজভীর চাদর স্রেফ চাদরই থাকছে না!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-03-23 11:22:34

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২০ মার্চ নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পরনে থাকা ভারতীয় পণ্য চাদর ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। এরপর উপস্থিত নেতাকর্মীরা সেই চাদরে আগুন দেয়। দলটির উল্লেখের মতো কেন্দ্রীয় এ নেতার হঠাৎ এমন কাণ্ড আলোচনার বটে। কোনরূপ ইঙ্গিত না দিয়ে হঠাৎ করে তার এমন কর্মকাণ্ডে সারাদেশে আলোচনার হলেও বিএনপি আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি।

চাদর ছুড়ে ফেলে দেওয়া এবং সেই চাদরে আগুন দেওয়ার ঘটনার আগে সংবাদ সম্মেলন করেন রুহুল কবির রিজভী। লিখিত বক্তব্যে তিনি আগাগোড়া ভারতবিরোধী নানা কথা বলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র ‘ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইনে’ উত্তাল বলেও মন্তব্য করেন। 'এই ক্যাম্পেইন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বাংলাদেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন' বলেও মন্তব্য ছিল তার। রিজভীর দাবি ছিল, বিএনপিসহ ৬৩টি দল এবং দেশপ্রেমিক জনগণ ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করছে। তিনি বলেন, 'ভারতীয় পণ্য বর্জন মানে আওয়ামী লীগ সরকারকে বর্জন; কারণ, আওয়ামী লীগ একটি ভারতীয় পণ্য।'

সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি সরকারের একাধিক মন্ত্রী, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সমালোচনা করেছেন। রিজভী বলেন, 'কথায় কথায় প্রায় সব মন্ত্রী ভারত-বন্দনায় মত্ত হচ্ছেন। তাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এখন ভারতের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।' তিনি বলেন, 'ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারত পাশে ছিল বলেই বাংলাদেশের নির্বাচনে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। হাছান মাহমুদ বলেছেন, দেশে ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ওই সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। এবারও ভারত আমাদের পাশে ছিল ও আছে।’

মন্ত্রীদের নিয়ে রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্য অসত্য নয়। সম্প্রতি এ দুই মন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভারতের সহযোগিতা বিষয়ে প্রকাশ্যে বলেছেন। মন্ত্রীরা আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কিছু দেশকে ইঙ্গিত করে কথা বলেছেন, বলেছেন ওই সময়ে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করেছিল, সে কথাও। গত নির্বাচনের আগে আমেরিকা ও ইইউভুক্ত কিছু দেশের অতি-তৎপরতা ছিল; এবং ওই সময়ে ভারত, চীন, রাশিয়া সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল—এটা মোটেও মিথ্যা নয়।

তবু কথা থাকে! কারণ দেশের দ্বিতীয় প্রধান বৃহত্তম দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতার বন্ধুপ্রতিম দেশের প্রতি এমন আচরণ কি প্রত্যাশিত? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যেখানে 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়', সেখানে বিএনপির মতো দলের রিজভীর মতো গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার এমন আচরণ সুবিবেচনার নয়।

এটা সকলের জানা যে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের প্রতিটি সরকারের সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এটা কংগ্রেস হোক, কিংবা বিজেপি—ওখানে সরকারি দলের নাম বদলালেও এখানে নীতি বদলায় না। এবং এটা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক থাকলে কোন দেশ, সরকার, দল যে ভালোভাবে চলতে পারে না; এটা বিএনপিকে দেখলে প্রমাণ হয়। প্রবল ভারতবিরোধী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একদা বিএনপি রাজনীতি করেছিল, কিন্তু বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে সেটা যে সম্ভব নয়, এ বোধ এখনো জন্মেনি দলটির।

এখানে বিএনপির আওয়ামী লীগকে দেখে শেখা উচিত। কারণ চলমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সমর্থন দিয়েছিল যে দেশগুলো তাদের মধ্যে আছে ভারত-চীন-রাশিয়া। এই দেশগুলো আবার পরস্পরের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয়। তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতা আছে, মতভিন্নতা আছে, মুখোমুখি অবস্থানও আছে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার পারস্পরিক অবন্ধু-ভাবাপন্ন অবস্থা সত্ত্বেও তাদেরকে বাংলাদেশ বিষয়ে এক মোহনায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছিল। বাংলাদেশ চীনের প্রতি ঝুঁকছে—এমন প্রচারণা কিংবা ইঙ্গিত সত্ত্বেও ভারত এক্ষেত্রে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। এখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার আওয়ামী লীগের দায়িত্বে রয়েছেন যারা তাদের মুনশিয়ানাকে অস্বীকার করার উপায় নাই। নির্বাচনের আগে আমেরিকা ও ইইউভুক্ত কিছু দেশের সঙ্গে যখন প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ সরকার, তখন ভারত-চীন-রাশিয়াকে এই আওয়ামী লীগ সরকারই আবার এক জায়গায় নিয়ে এসে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে।

বিএনপি আগে মনে করতো ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের সুসম্পর্ক। বিজেপি প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর আমরা দেখেছি বিএনপির উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ। বিএনপি আগে মনে করতো বিজেপি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ২০১৪ সালের টানা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে বিএনপির পক্ষ থেকে 'গুজব' ছড়ানো হয় যে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন। এরপর বিজেপির পক্ষ থেকে জানানো হয় এই খবর অসত্য। এরআগে ২০১৩ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশ সফরের সময় হোটেল সোনারগাঁওয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের সূচি ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া সেদিন তৎকালীন ২০-দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতে ইসলামির ডাকা হরতালের অজুহাতে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাননি। তখনো ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস এবং বিএনপি এখানে জামায়াতকে খুশি করতে এবং ওখানে বিজেপিকে খুশি করতে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএনপির এই অসৌজন্য এবং শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ শেষ পর্যন্ত ভারতকে হতাশ করেছিল এবং তারা যে বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি সেটা প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এর বছর দুয়েক আগে বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরে যান, এবং সেখানে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস ও বিজেপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ফিরে এসে ভারতের গুণগান গাইতে থাকেন।

ভারত মূলত বিএনপিকে বিশ্বাস করতে পারে না দলটির একেক সময় একেক নীতি ও অবস্থানের কারণে। বিএনপি কিছুদিন ভারতের গুণগান গায়, আর এর কিছুদিন পর ভারতবিরোধিতা করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ফেনি পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে, বিসমিল্লাহ উঠে যাবে, মসজিদে-মসজিদে উলু ধ্বনি উঠবে, 'গোলামির চুক্তি' বাস্তবায়ন হবে—এমন নানা উটকো প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছে বিএনপি। দলটির কিছু নেতা একদিকে ভারতের গুণগান গায়, আরেকদিকে কিছু নেতা ভারতবিদ্বেষি বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়। এমন অবস্থায় তাদেরকে বিশ্বাস করার যুক্তি থাকে?

বিএনপির এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণেই কিনা প্রতিবেশী দেশটি তাদেরকে আস্থায় নিতে পারে না। ফলে আমেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলোর বাংলাদেশকে নিয়ে অতি-তৎপরতার সময়ে দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর শেষ সময়ে এসে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশ্যে বলেছে—সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনের কথা। একই সুরে বলেছে চীন-রাশিয়াও।

রুহুল কবির রিজভীর ভারতীয় পণ্য ছুড়ে ফেলা, সেখানে আগুন দেওয়ার বিষয়কে সমর্থন এবং 'ভারত আউট ক্যাম্পেইনে' সংহতি প্রকাশে দিন শেষে লাভের কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। যদিও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারতের প্রতি দলটির বিরোধিতা সকল পর্যায়ে আরও বেড়েছে, তিনি নিজেও সংক্ষুব্ধ এক্ষেত্রে। তবে তার মতো একজন নেতার এমন প্রতিক্রিয়ায় তাদের প্রতি প্রতিবেশী দেশটির অবিশ্বাসকে আরও বাড়াবে। এই আচরণে তিনি হাততালি পেয়েছেন সত্য, কিন্তু দলের ক্ষতি করেছেন।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় বন্ধু দেশটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অন্য যে কারো চাইতে নিবিড়—এটা সত্য। তবু এখানে শত্রুতা না জিইয়ে, শত্রুতা না বাড়িয়ে বন্ধুত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। চাদর ছুড়ে ফেল দেওয়া, আগুন দেওয়ার বিষয়কে গ্রাহ্য করার মতো বালখিল্য আচরণে বিএনপির প্রাপ্তির কিছু নেই। বরং আছে সম্পর্ক অবনতির উপাদান। বিএনপির এত বড় নেতা হওয়া সত্ত্বেও রুহুল কবির রিজভী যদি বাস্তবতা অনুধাবন না করতে পারেন, তাহলে দলের অন্যরা কীভাবে পারবে?

রিজভীর চাদর দিনশেষে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। কিন্তু অঙ্গার হয়ে যাওয়া এই চাদর স্রেফ চাদরই থাকবে বলে মনে হয় না। এটা দূরত্ব তৈরির নতুন উপাদান হয়ে ওঠতেও পারে!

এ সম্পর্কিত আরও খবর