বাজার ব্যবস্থাপনার আইওয়াশ

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-03-19 21:14:56

সংযমের মাসে ক্রেতাসাধারণ অসংযমী; বিক্রেতারা বেপরোয়া। এরমধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ অথবা সরকার রয়েছে প্রতীকী কাজে। বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়ার চাইতে লোকদেখানো কাজে ব্যস্ত। রমজানের শুরু থেকেই দেশের নানা প্রান্তে প্রশাসনের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে, কিন্তু এগুলো আদতে লোকদেখানো। নির্দিষ্ট কিছু দোকানে যাওয়ার পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অথবা পরিচিতদের মাধ্যমে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশেই দায়িত্ব সারা। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেখানে থেকে যাচ্ছে।

বাজারে ঘুরতে গিয়ে কাল একটা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান দেখলাম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখলাম একটা ফলের দোকানের সামনে দলবল নিয়ে যেতে। ফলের দোকানে গিয়ে তার প্রাথমিক এবং একমাত্র লক্ষ্যই যেন খেজুরের দাম। যেন খেজুরই সমস্যা ভোক্তাসাধারণের। অথচ এটা অতি-জরুরি কোন পণ্য নয় মানুষের। শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন ইফতারিতে খেজুরের উপস্থিতি নিয়ে উটকো মন্তব্য না করলে বোধহয় খেজুর নিয়ে এত মাতামাতি হতো না দেশে। কেবল শিল্পমন্ত্রীই নয় আরও কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এই খেজুর-বিরোধিতা করেছেন। ফলে সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে হুট করে বেড়ে গেছে খেজুরের গুরুত্ব। অথচ এই খেজুর এত আলোচিত ছিল না দেশে। এই খেজুর খাওয়া, না খাওয়া নিয়ে মানুষ ভাবত সামান্যই।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এই যে খেজুর-প্রীতি তা ভোক্তাসাধারণের পক্ষে-বিপক্ষে কিছুই যাচ্ছে না। স্রেফ লোকদেখানো হিসেবে থেকে যাচ্ছে। তাদের অভিযানগুলো গণমাধ্যমে জায়গা পেতে, সামাজিক মাধ্যমে নিয়ে আসার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে হয়। অথচ তারাও জানে এই খেজুর মানুষের নিত্যভোগ্য কোন পণ্য নয়। মন্ত্রীর অনিয়ন্ত্রিত বক্তব্যে এটা আলোচিত হয়েছে বলেই সামাজিক মাধ্যমে এক শ্রেণির মানুষ এটাকে 'সুন্নত' বলে প্রচারের সুযোগ পেয়েছে। দেশের লাখো মানুষের যেখানে ফি-বেলা খাবারের সংস্থান নেই সেখানে খেজুরের আলাপ বিলাসিতা বৈ কিছু নয়।

খেজুর ছাড়াও তরমুজের দিকে দেশের নানা প্রান্তের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ঝোঁক। কেজি দরে নাকি পিস হিসেবে বিক্রি, এবং কত দামের খেজুর ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কত দরে বিক্রি হলো এটা আরেক ভাইরাল সংবাদ। এইধরনের সংবাদের ফেসবুক-ভোক্তা আছে, তাই সবার নজর এদিকে। অথচ এটাও বেঁচে থাকার আবশ্যকীয় পণ্য নয় মানুষের। তবু এখানে মিডিয়ার ঝোঁক, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ঝোঁক!

রমজান শুরুর আগে মন্ত্রীদের মুখ থেকে আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা শুনে এসেছি। কিন্তু দিনশেষে একটা বিশাল অশ্বডিম্বের দেখা মিলল। সেই আগের মতোই বাজারে নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের-প্রশাসনের। আগের দামেই এবং আগের চাইতে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। গত ১৫ মার্চ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ করিমের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে মাছ-মাংসসহ ২৯ কৃষিপণ্যের 'যৌক্তিক মূল্য' নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। দাম নির্ধারণের পরের দুইদিনেও বাজারে এর কোন প্রভাব দেখা যায়নি। কেউ মানেনি নির্দেশনা। অনেকেই জানে না সরকার থেকে দেওয়া এমন নির্দেশনার কথা। আর এদিকে, এই নির্দেশনার প্রচারেও নেই সরকারের আগ্রহ। স্রেফ লোকদেখানো একটা প্রজ্ঞাপন দিয়ে দায় সেরেছে সরকার। এ বড্ড প্রহসন ভোক্তার সঙ্গে, জনতার সঙ্গে!

ভ্রাম্যমাণ আদালতের কথা বলছি, গণমাধ্যমেও আসছে অভিযান ও জরিমানার খবর। এগুলোকে এখনো বলতে হচ্ছে প্রতীকী অভিযান। কারণ জেলা কিংবা উপজেলা শহরের পাঁচ-সাতটা কিংবা সংখ্যায় তারচেয়েও কম কয়েকটা দোকানে অভিযান চালিয়ে কি সারাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা সম্ভব? জেলা ও উপজেলা শহরগুলো বাদে দেশে লাখ লাখ হাটবাজার আছে, সে সবেও নাই নিয়ন্ত্রণ। ওসব জায়গায় থাকে ভোক্তাদের নিত্য ভিড়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের যে অভিযান সেগুলো আবার শহরকেন্দ্রিক, কিন্তু ভোক্তাদের সিংহভাগ শহরকেন্দ্রের নয়, প্রান্তিক হাটবাজারের। ফলে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়টি সত্ত্বেও কোন প্রভাব পড়ার কথা নয়, পড়েওনি। দাম নির্ধারণের পর যেভাবে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা ছিল সেটাও হয়নি। এছাড়া ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই বিশ্বাস পোক্ত রয়েছে যে প্রশাসন তাদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না। ফলে বাজার রয়েছে নিয়ন্ত্রণহীন।

কোন ধরনের ইঙ্গিত না দিয়ে হুট করে নিত্যব্যবহার্য ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার মাঝেও আবার মতভিন্নতা আছে। সব ব্যবসায়ী কি নিত্যদিন সওদা করে? করে না। খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি দামে কিনেছে, বেচতে হচ্ছে বেশি দামে--এমন একটা দাবি আছে। এই দাবির সর্বাংশে সত্যতা না থাকলেও ডাহা মিথ্যা নয়। পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে এমন কোন ইঙ্গিত থাকলেও বাজার পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছাত না। এই সুযোগে যে যার ইচ্ছা তেমন দাম নিয়েছে, নিচ্ছে। রমজানের আগে এইধরনের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে এর বহুল প্রচারণা করলে অসাধু ব্যবসায়ীদের 'মানুষের গলা কাটার' সুযোগ নিতো না।

দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি যে পণ্যের দাম উঠে সেটা আর নামে না। চাল-ডাল-সয়াবিন-পেঁয়াজসহ নিত্যব্যবহার্য কিছু পণ্যের দাম নিয়ে আলোচনা হয়, আর এই সুযোগে আলোচনায় না থাকা অন্য সকল পণ্যের দাম আকাশে উঠে যায়। মরিচ, হলুদ, বাখর, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, চা, চিনি, দুধ--কোন পণ্যের দাম আছে নিয়ন্ত্রণে? কোনোটিরই নেই। এইসব পণ্যের দাম কে বাড়ায়, কীভাবে বাড়ানো হয়, সেটাও কেউ জানে না, কেউ এসব নিয়ে কথাও বলে না। ফলে প্রকৃতই নিয়ন্ত্রণহীন বাজার।

বাজার পরিস্থিতি যখন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা খেজুর-তরমুজ আর ফলমূল নিয়ে নাটকের মঞ্চায়নে। খেজুর-তরমুজের ফেসবুক-দর্শক আছে ঠিক, কিন্তু সে তুলনায় ভোক্তা নেই। বেঁচে থাকার সংগ্রামে যেখানে চাল-ডালই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, সেখানে আবার খেজুর-তরমুজ?

এ সম্পর্কিত আরও খবর