এ প্রবণতা ভয়ঙ্কর: নীরব থাকতে পারি না

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম | 2024-03-16 20:24:11

এক ভয়ঙ্কর প্রবণতার দিকে এগোচ্ছে আমাদের সমাজ। একটি সমাজ কতটা পতিত হলে আত্মহননের মতো ভয়ঙ্কর প্রবণতায় নিত্যদিনকার স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নেয়, তা বোধহয় আমরা টের পেতে শুরু করেছি। পবিত্র রমজানে সাহরি খেয়ে ফজরের নামাজের পবিত্রতাকে সঙ্গী করে আরও কিছু সময় ঘুমিয়ে নিতে শুয়েছিলাম। ততক্ষণে সকাল ৯টা বেজে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে উঠেই হাতে ফোন নিয়েছি। এত ঘটনাবহুল সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি যে, প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটনের খবরে চমকে উঠতেই হবে। নেতিবাচিক খবরে প্রতিদিন এভাবে আশাহত মনে ‘দিবসের কার্য’ আরম্ভ করতে গিয়ে মনোজগতে কী যে প্রভাব পড়ে! অসহিষ্ণু সমাজের বৈকল্যকে সাক্ষী মেনে আরও একটি আত্মহননের খবর পেলাম ফোন হাতে নিতেই। আত্মহননের ক্রমশ দীর্ঘতর হতে থাকা এই তালিকায় এবার নাম লেখালেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা।

দেশবরেণ্য শিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহননের ক্ষত এখনও শুকায়নি। এই শোকের মধ্যেই আরও একটি আত্মহননের খবর এলো এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে উচ্ছ্বল তারুণ্য নিয়ে যে ছেলে বা মেয়েটি নিজের ক্যারিয়ারের সঙ্গে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করবে; সমাজ ও পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে, সে কী না আত্মহননের পথ বেছে নিলো, পড়াশোনা শেষ করে যার স্বপ্ন ছিল বিচারক হওয়ার!

সংবাদমাধ্যমের খবরে আমরা যা জানতে পারছি, তাহলো- ফাইরুজ অবন্তিকা স্যোশাল মিডিয়ায় এক নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাসে আত্মহনের কৈফিয়ত দিয়ে নেপথ্যের কারণ জানিয়েছেন। খবরে প্রকাশ, শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাত সাড়ে নয়টার দিকে ফেসবুকে এক পোস্ট করে কুমিল্লার নিজের বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। অবন্তিকা তার শেয়ার করা পোস্টে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই, তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।’

সেই পোস্টের এক জায়গায় অবন্তিকা সহকারী প্রক্টরের ভূমিকায় ক্ষোভ জানিয়ে লিখেছেন, ‘কোথায় এই লোকের কাজ ছিল গার্ডিয়ান হওয়া আর সে কিনা শেষমেশ আমার জীবনটারেই শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি দিলো না।’

ইতোমধ্যে, আমরা জেনেছি, ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে (আম্মান সিদ্দিকী) সাময়িক বহিষ্কারের পর দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্ররোচনা দানকারী শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি সহকারী প্রক্টরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে ‘আইনগতভাবে যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন জবি উপাচার্য সাদেকা হালিমও। কিন্তু একটি সরল জিজ্ঞাসা আমাদের, এই ঘটনার ঘটার আগে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই বিষয়টি অবগত ছিলেন না! স্বাভাবিক জ্ঞান বলে, নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই জানতেন ঘটনাটি কিন্তু দুষ্টচক্রের দুর্ভেদ্য যে গণ্ডি তা অতিক্রম করতে পারেনি বলেই অবন্তিকাকে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হলো। আমরা জানি না, অবন্তিকার মতো এমন কত শিক্ষার্থী এমন ভয়ানক প্রবণতা নিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গনে তৈরি হচ্ছেন!

প্রতিবারই যখন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে, সর্বত্র অনেক হৈচৈ হয়, আলোড়ন হয়। তারপর কিছুদিন যেতেই সবকিছু সুনসান, সব স্বাভাবিক। সমাজ যেভাবে চলার সেভাবেই আপন নিয়মে চলতে থাকে। সে কারণেই অবন্তিকাদের মৃত্যুর মিছিল থামে না। অনাকাঙ্খিত এ ধরনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান ঘাটতে গিয়ে আঁতকে উঠতে হলো! কেবলমাত্র গেল এক বছরে সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫শ ১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্য বলছে, আত্মহত্যার এই তালিকায় সব থেকে বেশি আছেন নারী শিক্ষার্থীরা, যার সংখ্যা ৬০ দশমিক ২ শতাংশ। আর সংখ্যার বিচারে এক্ষেত্রে এগিয়ে স্কুলগামীরা। তালিকায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ৯৮ জন ও মাদ্রাসার ৪৮ জন শিক্ষার্থীও।

ভাবা যায়, এত মৃত্যুর পরেও আত্মহননের প্রতিকারে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র কি নড়েচড়ে বসেছে আদৌ! এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলোর গভীরে গিয়ে যা দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ আত্মহননের ঘটনাই শিক্ষার্থীরা ঘটাচ্ছে এবং পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক ছিল না। সংক্ষুব্ধদের অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমলে না নেওয়ায় হতাশার চরমে পৌছে শিক্ষার্থীরা এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছেন।

যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে একজন শিক্ষার্থী যখন বিচারের জন্য শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের দ্বারস্থ হন তখন তারা কীভাবে অভিযুক্তের পক্ষ নেন, তা আমাদের জানা নেই। শিক্ষকের নৈতিক মূল্যবোধের যে বিরাট অবক্ষয় আমরা এই সময়ে লক্ষ্য করছি, তাকে কিছুতেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। মাদ্রাসা থেকে স্কুল-কলেজ এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়েও এই প্রবণতা দিনকে দিন প্রবল হচ্ছে। অবন্তিকার ক্ষেত্রে আসলে কী ঘটেছিল, তা উদঘাটনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছে। ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু ইতোপূর্বে সাম্প্রতিককালে যেসব আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আসল রহস্য উন্মোচিত হতে দেখি না। ক’দিন যেতে না যেতেই কোথায় যেন সব চাপা পড়ে যায়!

দেশের বিদ্যাপীঠগুলোতে পাঠদানের নির্ধারিত যোগ্য শিক্ষকেরই যেখানে ঘাটতি, সেখানে মানসিক অবসাদে থাকা শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রেখে কাউন্সেলিং প্রদানের আশা দুরাশারই নামান্তর হয়ত, কিন্তু ক্ষত যেভাবে বড় হতে শুরু করেছে, সেখানে আত্মহননের এই প্রবণতা থামাতে এখনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারির মাধ্যমে হলেও সম্ভাব্য সব রকমের প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে নেওয়া উচিত। সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রতিথযশা শিক্ষাবিদদের এ নিয়ে সোচ্চার হওয়ার এখনি সময়। এক বছরেই যদি ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী শুধুমাত্র আত্মহননের পথ বেছে নেন এবং কোনো প্রতিকারমূলক কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে সংখ্যাটি কয়েকগুণ হতেও সময় নেবে না, তা জোর দিয়েই বলা যায়। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের সচেতনতা যে উল্লেখযোগ্য নয়, তা কমবেশি সবাই জানি, কিন্তু এটি যেভাবে ভয়াল রূপ নিয়ে প্রজন্মকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে, তা উদ্বেগজনক।

আমরা প্রত্যাশা করবো, ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহননে প্ররোচনায় উপাচার্য সাদেকা হালিমের প্রতিশ্রুত ‘হাতে থাকা সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহারের’ প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নসহ সত্যিকারের ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ যেন অবিলম্বে নিশ্চিত করা হয়। ‘নারী ক্ষমতায়তনে আমাদের প্রভূত অগ্রগতি সাধন হয়েছে’ মর্মে আমরা যে বাগাড়ম্বর করে আসছি, সেই অতিশয়োক্তির প্রতি করুণা করে বলতে চাই, ক্ষমতায়ন নয় বরং সমতায়তন করুন। সবাইকে মর্যাদা নিয়ে সমভাবে বাঁচতে দিন। সবধরনের আত্মহননের প্ররোচনামুক্ত সমাজ, শিক্ষাঙ্গন গড়ে উঠুক। এই সমাজকে পুরোপুরি 'পতিত' বলে ওঠার আগেই রাষ্ট্র এর প্রতিবিধানে সচেষ্ট হোক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর