জাকির তালুকদারের পুরস্কার নেওয়া ও ফেরত দেওয়া

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2024-01-29 16:04:42

 

উল্লেখের মতো কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটা চিঠির উপরাংশ এবং লাখ টাকার একটা চেকের ছবি প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পাঠিয়ে দিলাম। খুব ভারমুক্ত লাগছে।’

ফেসবুকে তাৎক্ষণিক কিছু না লিখলেও কিছু গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন জাকির তালুকদার। সে সব জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, প্রতিষ্ঠানের মানের নিম্নগামিতা এবং আড়াই দশক ধরে নির্বাচন না দিয়ে নিজেদের পছন্দমত লোক দিয়ে একাডেমি পরিচালনায় নির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠানের মান যখন নিম্নগামী হতে থাকে, তখন এই পুরস্কার অর্থহীন হয়ে যায়। এজন্যই আমি পুরস্কার ফেরত পাঠিয়েছি।’ পুরস্কার ফেরত দেওয়া এ কথাসাহিত্যিকের ভাষায় পুরস্কারের মান নিম্নগামী হয়েছে, বাংলা একাডেমিতে গণতন্ত্র নেই, আমলাতন্ত্র জেঁকে বসেছে, আড়াই দশক অর্থাৎ পঁচিশ বছর ধরে নির্বাচন না দিয়ে সেখানে নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা হচ্ছে।

জাকির তালুকদারের ভাষায় তিনি ‘ভারমুক্ত’ হয়েছেন। দশ বছরের মতো সময় তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের ‘ভার’ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। ‘ভারমুক্ত’ জাকির তালুকদার পুরস্কারের অর্থমূল্যের অর্জনকালীন মূল্য ফেরত দিয়েছেন, চিঠিতে কী লিখেছেন তিনি সেটা জানা যায়নি; কারণ লিখবেন নিশ্চয়। ২০১৪ সালে তিনি পেয়েছিলেন এ সাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কারের এক লাখ টাকা অর্থমূল্যের সঙ্গে তিনি পেয়েছিলেন সম্মাননা সনদ, সম্মাননা স্মারক এবং বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ। ফেসবুকে প্রকাশিত পাঁচ শব্দের দুই বাক্যের পোস্টের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে তিনি কেবল পুরস্কারের অর্থমূল্যের অর্জনকালীন অর্থের চেক ফেরত দিয়েছেন। এরবাইরে বাকি থাকে সম্মাননা সনদ-স্মারক ও ফেলোশিপ; সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

দশ বছর আগে পাওয়া পুরস্কার ফেরতের পর বাহবা পাচ্ছেন জাকির তালুকদার। এটা তিনি পেতেই পারেন। তাঁর সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। মানুষ যেখানে কোনোকিছু প্রত্যাখ্যান, বর্জন ও ফেরত দেওয়ার কথা চিন্তা স্বাভাবিকভাবে করে না, সেখানে তিনি সেটা করে দেখিয়েছেন। তবে তিনি কিন্তু এই পথের একক ব্যক্তি নন। এরআগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ না করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়াও আমরা দেখেছি এরআগে। এবং সেটা করে দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) একাংশের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এরআগে তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্বও গ্রহণ করেননি বলে খবর। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছিল ২০১৫ সালে। বামপন্থী এই রাজনীতিক দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হয়েও সেটা গ্রহণ করেননি। জাকির তালুকদার তুলনামূলক কম গুরুত্বের পুরস্কার গ্রহণ করেছেন, ভোগ করেছেন, এবং পুরস্কারের মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়ার পর একটা পর্যায়ে এসে কিছু অভিযোগ এনে সেটা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

 

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের অভিযোগ, পুরস্কারের মান নিম্নগামী। মান নিয়ে এই অভিযোগ নতুন নয়। তিনি পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকেই এইধরনের সমালোচনা চলে আসছে। প্রতিবারই পুরস্কারের ঘোষণার পর নানামুখী আলোচনা হয়। বাংলা একাডেমির পরিচালনা ও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হয়, প্রতিবাদও হয়, সুতরাং এটাকে নতুন কোন অভিযোগ বলে মনে করার কারণ নাই। প্রতিষ্ঠানটিতে গত ২৫ বছর ধরে অনির্বাচিতরা দায়িত্ব পালন করে আসছেন, এই অভিযোগও তাঁরও। অথচ তিনি যখন পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন সেই সময়েও এই ধারা ছিল, এখনো আছে। অনির্বাচিতদের পক্ষ নিচ্ছি না, কিন্তু পুরস্কার ফেরতের সময়ে যদি এটা হয় অভিযোগ তখন গ্রহণের সময়ে ভিন্ন চিত্র ছিল না। বাংলা একাডেমির পুরস্কারের নীতিমালা অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি একবারই পেতে পারেন এই পুরস্কার। অর্থাৎ জাকির তালুকদারসহ অন্যদের যারাই পেয়েছেন পুরস্কার, তাঁরা আর মনোনয়নের তালিকায় থাকছেন না।

তিনি গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগে হয়ত সত্যতা আছে। কিন্তু আয়নায় মুখ দেখলে গণতন্ত্রের বিশালত্বের একটা অংশ মতপ্রকাশের এবং লেখালেখির স্বাধীনতার প্রতি তিনি কি সত্যিই বিশ্বাসী? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে বছর তিনি বাংলা একাডেমির পুরস্কার পেয়েছিলেন সে সময়ের আগে-পরে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের হাতে একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছিলেন মুক্তচিন্তার লেখক-ব্লগারেরা। সে সময় তাঁর মতো পুরস্কারপ্রাপ্তদের লেখকদের যেখানে মতপ্রকাশ ও লেখালেখির স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোর কথা ছিল, তখন তিনি কথা বলেছিলেন উগ্রবাদী ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের পক্ষেই। আক্রান্ত মুক্তচিন্তকদের পাশে না দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশে গিয়ে পাকা পায়খানায় পায়খানা করার লোভে ব্লগাররা ইসলামের বিরুদ্ধে লেখে।’ নিজে লেখালেখির জগতের মানুষ, পুরস্কার ফেরত দেওয়ার সময়ে গণতন্ত্রের দোহাই দেওয়া জাকির তালুকদারের এ কেমন গণতন্ত্র, যেখানে তিনি নিজেই অন্যের লেখালেখির স্বাধীনতাকে স্বীকার করেন না?

একসময় প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গ দেওয়া জাকির তালুকদার পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক। আর্থিকভাবে সচ্ছল তিনি। তাই তাঁর পুরস্কারের অর্জনকালীন অর্থমূল্য ফেরত দিতে সমস্যা হয়নি। তবে এই পুরস্কারের মাধ্যমে তিনি যে পরিচিতি ও লেখক সম্মান পেয়ে এসেছেন, সেগুলো কীভাবে ফেরত দেবেন? এটা ফেরত দেওয়া তো অসম্ভব! বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ জাতীয় পর্যায়ের অনেকগুলো পুরস্কার অনেক লেখককে জাতীয়ভাবে পরিচিতি দেয়। বাস্তবতা এমন হলেও এটা বেশিরভাগই স্বীকার করে না, জাকির তালুকদার ও তাঁর ভক্তরা এটা স্বীকার করবে না। পুরস্কার না পাওয়া অনেক গুণী লেখক আলোচনায় আসেন না স্বীকৃতির অভাবে, জাকির তালুকদার পেয়ে আলোচনায় এসেছেন; এটা অস্বীকার করলেও মিথ্যা হয়ে যাবে না!

তবে কি কোন লেখক প্রতিবাদে পুরস্কার ফেরত এবং পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না? ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এমন সুযোগ থাকা উচিত। জাকির তালুকদারেরও থাকা উচিত। তবে যে অভিযোগে পুরস্কার ফেরতের পর যদি দেখা যায় উল্লিখিত অভিযোগে ব্যক্তি নিজেই অভিযুক্ত, তবে তাঁর/তাঁদের প্রত্যাখ্যান অথবা ফেরতকে মহিমান্বিত করার কিছু নেই।

জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দশ বছর পর ফেরত দিয়েছেন। ফেরতের এই সিদ্ধান্ত তাঁর চিন্তার স্বাধীনতা। লেখকের লেখার স্বাধীনতা বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান নেওয়া সত্ত্বেও এটাকে ইতিবাচকভাবে নেওয়া পরমত সহিঞ্চুতা। বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা হবে কর্তৃপক্ষের ঔদার্য। তাঁর সিদ্ধান্ত ও সাহসের প্রশংসা করি!

এ সম্পর্কিত আরও খবর