এই স্বীকারোক্তি ঔদার্যেরই অভিব্যক্তি

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-04 23:10:04

সমাজে বিভাজন এতো বিকশিত হয়েছে যে, সেই বিভাজিত সমাজের সামষ্টিক রূপ যখন রাষ্ট্র সেখানে নিরঙ্কুশ বলে কিছু নেই। সমাজ বিজ্ঞানের চিরায়ত পাঠও বদলে গেছে সমকালীন বাস্তবতার কাছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে তা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। ভাষণের শেষ দিকে শেখ হাসিনা দেশের আপামর জনগণের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত বিনীতভাবে কয়েকটি কথা উচ্চারণ করেছেন, এখনকার সমাজ বাস্তবতার নিরিখে এর অনেকগুলো পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে।

জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘চলার পথে যদি কোন ভুল-ভ্রান্তি করে থাকি আপনারা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, আবার সরকার গঠনের সুযোগ পেলে শুধরানোর সুযোগ পাব। এই অকপট উচ্চারণের পূর্বে সরকারপ্রধান বক্তব্যে তাঁর সরকারের গৃহীত উন্নয়ন পরিক্রমার বিস্তারিত ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তিনি তাঁর জনগণের জন্য নেওয়া পদক্ষেপ-কর্মসূচি তুলে ধরার সঙ্গে এও উপলব্ধি করেছেন যে মানুষ হিসেবে তাঁরও ভুল হতে পারে। মনুষ্য জীবনে ভুল করার যে প্রবৃত্তি, তাকে স্বীকার করে নিয়ে শেখ হাসিনা ‘ভুল-ভ্রান্তি’র জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের ঔদার্যকেই বড় করে তুললেন।

আমরা লক্ষ্য করেছি, নিজের চিন্তা ও কর্ম এবং সরকারের কর্ম-প্রয়াস নিয়ে জনগণের কাছে স্বপ্রণোদিত জবাবদিহিতায় শেখ হাসিনা এক রকম দৃষ্টান্তই গড়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে বারবরই তিনি সংবাদ সম্মেলন ডেকে সফরের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সংবাদ সম্মেলনে অনেকটা সময় দিয়ে সাংবাদিকদের অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে তার প্রতিটির জবাব দেন তিনি। এই সময়ের রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে তো বটেই অনেক পূর্বের রাষ্ট্র প্রধানরাও এমন দৃষ্টান্ত দেখাননি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন নিয়ে মহল বিশেষের সমালোচনা থাকতে পারে যে সেখানে সরকার সমর্থক সাংবাদিকরা তোষামোদী প্রশ্নের অবতারণা করেন কিন্তু আমরা লক্ষ্য করে দেখব, সেখান থেকে প্রচুর জনজিজ্ঞাসারও নিরসন হয়। পাশ্চাত্যের দেশসমূহের সরকার প্রধানদের সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকরা কতখানি প্রশ্ন করার সুযোগ পান বা কাছে যাওয়ার সুযোগ মেলে তা আমরা জানি। সেই দিক থেকে আমরা যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণমাধ্যমবান্ধব সরকারপ্রধান বলি তবে তা অত্যুক্তি হবে না বৈকি!

বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের পূর্বে এদিন দুপুরে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের শেষ জনসভায় নারায়নগঞ্জে দীর্ঘ বক্তৃতা করেছেন তিনি। শেখ হাসিনা তাঁর সরকারামলের গৃহীত উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরে এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য জনগণের সমর্থন চেয়েছেন। ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথাও সবিস্তারে জানিয়েছেন। স্বপ্রণোদিত জবাবদিহিতার এই প্রবণতা একজন শাসকের মর্যাদাকে বাড়িয়ে তুলে।

বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক দেশ বেশ তৎপর রয়েছেন, আমরা জানি এই তৎপরতা কতখানি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে আর কতখানি তাদের নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে। সেখানে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে একটি বড় বিবেচনা বোধহয় পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া কতটুকু সৌহার্দ্যপূর্ণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দশকে এটি একটি বড় বিস্ময়কর ঘটনা যে বিশ্বের মোড়ল বলে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সমর্থক রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে শীতল সংঘাতে জড়িয়েও আমরা ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি।

পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মদদে বা পরোক্ষ অঙ্গুলিহেলনে আর্থিক খাতের অনেক বিশ্ব সংস্থা বিস্তর বাধা সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের মানুষের মনে এই প্রতীতি জন্মেছিল যে হয়তো এই প্রকল্প বাস্তবায়ন দুঃস্বাধ্যই হয়ে উঠবে। কিন্তু একজন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দৃঢ়তার সঙ্গে সকল ষড়যন্ত্র ও হুমকি উপেক্ষা করে এই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অনড় থাকেন এবং ফলশ্রুতিতে তা আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। কেবলমাত্র এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তা বলাই বাহুল্য।

আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, আজ যা সপ্তম আশ্চর্য হিসেবে পৃথিবীর অগণিত পর্যটকদের অপার বিস্ময় সেই তাজমহল নির্মাণে মোগল সম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট শাহজাহানকে রাজকোষ প্রায় ফাঁকা করতে হয়েছিল। যার ফলে সাম্রাজ্য বাঁচাতে পুত্র আওরঙ্গজেব পিতাকে বন্দি করে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। কিন্তু পদ্মাসেতুর মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নেও দেশ সচলই কেবল থাকেনি, বরং অর্থনীতির গতিপ্রবাহই বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিরাট সাফল্যের সার্থক নির্মাতা একজন শেখ হাসিনা।

রাজনৈতিক বিতর্ক পাশে রেখে আমরা যদি ইতিহাসের নিরিখে বিচার করি তবে একটি দেশের এ ধরণের আমূল পরিবর্তনের কারিগররা সমকালে দাঁড়িয়ে হয়তো যোগ্য সম্মান না পেলেও মহাকাল তাদের ঠিক জায়গায় সমাসীন করে। শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে যেসব কথার অবতারণা করেছেন, তাতে তাঁর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ ফুটে উঠেছে।

বিভাজিত একটি সমাজে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন যেভাবে গভীরে প্রোথিত হয়েছে সেরকম একটি রাষ্ট্রের রাজদণ্ড হাতে সবাইকে খুশি রেখে নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ এক রকম অসম্ভব ব্যাপার-এটি এক ধ্রুবসত্য। কিন্তু জনগণের কাছে বিনয়ী হওয়ার প্রবৃত্তি, নিজের ‘ভুল শোধরানোর’ প্রত্যয় শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত এক প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরলো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর