আমার ভোট কেন গুরুত্বপূর্ণ? 

, যুক্তিতর্ক

শরিফুল হাসান সুমন | 2024-01-04 13:54:13

আমার ভোট আমি দেবো/ যাকে খুশি তাকে দেবো”—এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে সুন্দর বহিঃপ্রকাশ। গণতন্ত্র, যেখানে সকল ক্ষমতা মুল জনগণ, আর সেই প্রয়োগের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হচ্ছে বছর পরে পরে হওয়া জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমের জনগণ বেছে নেয় কে হবে তার সমস্যা, প্রতিকার, উন্নয়নের প্রতিনিধি, কাকে আমি ভরসা করে আমার সমাজ, এলাকা আর আমার নিজের পরিবারের আগামী পাঁচ বছরের নিরাপত্তা, উন্নয়ন প্রগতির দায়িত্ব তুলে দেবো। আমার দল বা আমার মার্কা নির্বাচনে নাই, তাই ভোট দিতে যাবো না, এটা অনেকটাই একতরফা নির্বাচন বয়কট করার মতোই। এই যে পার্টিজান পলিটিক্স, এই যে আদর্শ, মতাদর্শহীন ভাবে কোন নির্দিষ্ট মার্কার প্রতি অন্ধত্ব এটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

৭০-এর নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ ছিল স্বাধিকারের পক্ষে

আমার ভোট কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বাঙালির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেখা গেছে ৭০-এর নির্বাচনে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর। এই দিনটিতে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সে নির্বাচনের পর বিজয়ী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। এর জের ধরে শুরু হওয়া তীব্র রাজনৈতিক সংকট শেষ পর্যন্ত যা গড়ায় বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। একটি ভোটের মাধ্যমে বাংলাই তাদের জবাব দিয়ে দিয়েছিল যে বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, শাসন শোষণ থেকে তারা মুক্তি চায়, এতটা শক্তি ছিল আমার একটা ভোটের, প্রতিটা মানুষের ভোটের। যার ফলে এসেছিল ৭ই মার্চ, এসেছিল অসহযোগ আন্দোলন, এসেছিল মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। সেটা ছিল ভূখণ্ডের স্বাধীনতা। এই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল প্রায় ৬৩.% শতাংশ মানুষ

৭৩-এর নির্বাচন ভোটার অংশগ্রহণ ছিল স্বনির্ভর বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষে

এর পরে আরেকটি ঐতিহাসিক নির্বাচন এসেছিল ১৯৭৩ সালে, যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভোট দিয়েছিল বাঙালি।  সেই নির্বাচনে বাঙালি ৫৪.৯১% শতাংশের উপরে ভোট দিয়েছিল। অর্থনৈতিক মন্দা, হাহাকার, দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচার জন্য আস্থা রেখেছিল বঙ্গবন্ধুসহ চার নেতার নেতৃত্বে। বাঙালি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিল, এরাই পারবে স্বপ্নের স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয় হানাদারের দোসর আর স্বাধীনতা বিরোধীদের করা নির্মম হত্যাযজ্ঞে।

৯১-এর নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে

এরপরে শুরু হয় গণতন্ত্র হারিয়ে যাওয়ার দশক, গণতন্ত্র হত্যার দশক। স্বৈরশাসনের শেষ হয় ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৯১ সালের সেই নির্বাচনে ৫৫.৪৫ শতাংশ ভোট দেয় বাঙালি। তারা ভোট দেয় ভোটের অধিকার ফিরে পেতে, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে। 

২০০১-এর নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ ছিল সমৃদ্ধির পক্ষে

২০০১ সালের নির্বাচনেও ভোটার অংশগ্রহণ অনেক বেশি ছিল, ৭৪.৯৭% যদিও খুব অল্প ব্যবধানে (.৮৩%) জিতে ক্ষমতায় আসে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের জোট, আর উল্টাযাত্রা শুরু হয় গণতন্ত্রের, সমৃদ্ধির। সেটা ছিল শাসকের ভুল, কারণ তারা জনগণের ইচ্ছাকে বুঝতে পারে নাই, বা বুঝতে পারলেও অন্য কোন জঙ্গিবাদী অপশক্তি তাদের প্ররোচিত করেছিল। যার জবাব জনগণ দেয় পরের নির্বাচনে। 

২০০৮-এর নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ ছিল ইতিহাসের দায়শোধের 

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক নির্বাচন ছিল ২০০৮-এর নবম জাতীয় নির্বাচন। অনেকগুলো ইস্যু ছিল এই নির্বাচনে মানুষের বিপুল বিক্রমে ভোট প্রদান করে। তারমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আর যুদ্ধাপরাধীর বিচার সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল ভোটারদের। আর ২০০১-এর নির্বাচনে জনমত প্রতারিত হওয়ার প্রতিশোধও ছিল এই নির্বাচনে, ২০০১- যেই যুদ্ধাপরাধী জোট খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে (৪০.৯৭% ভোট) ২০০ আসনে জয় পেয়েছিল, তারাই ২০০৮- এসে আসন পায় মাত্র ৩২টি আর ভোট কাস্ট পায় মাত্র ৩২.৫০%

কেন ভোট দেওয়া উচিত?

উপরের প্রতিটা নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে, কারণ হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ, আর পরিবর্তনের ইচ্ছা। আর ভোটারদের এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনগুলো সবসময়ই বাংলাদেশের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিতে বড় প্রভাব বিস্তার করেছে। ভোটারদের পরিবর্তনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করা প্রতিটা ইলেকশনই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রূপরেখা গড়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষই সম্ভবত রাজনীতি সচেতন। হাটে মাঠে ঘাটে, হেঁসেলে আমাদের আলোচনা জুড়ে থাকা রাজনীতি। এই যে রাজনীতি সচেতনতা, এই যে স্থানীয় চেয়ারম্যান, নেতার ভুল, অন্যায় ধরে ফেলতে পারা, সেই সক্ষমতা দেখানোর হাতিয়ার হচ্ছে ভোট। সকল কিছু যা আমার পছন্দ না, তার জবাব দেওয়ার হাতিয়ার হচ্ছে ভোট। এই ভোটের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে জবাব দিয়েছিলাম ৭০-,, এই ভোটার মাধ্যমে আমরা স্বৈরাচারকে জবাব দিয়েছিলাম ৯১-, এই ভোটের মাধ্যমে আমরা দেশবিরোধী আর যুদ্ধাপরাধীদের জবাব দিয়েছিলাম২০০৮-, এই ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর অগ্রগতির পথ বেছে নিয়েছিলাম ২০১৪-তে। সেই একইভাবে আবার ভোটদানের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত আমরা কী চাই, কোথায় নিয়ে যেতে চাই আমাদের প্রিয় স্বদেশকে।

যদি ক্ষমতাসীনের পরিকল্পনা আর রূপরেখা পছন্দ হয়, তাহলে তাকে ভোট দিয়ে জানিয়ে দেব, আমিও এই পরিকল্পনার অংশ। আর যদি সেই পরিকল্পনা পছন্দ না হয়, তাহলে তার বিপরীতে দাঁড়ানো কাউকে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ জানাব ক্ষমতাসীনদের রূপরেখা আর পরিকল্পনাকে।   

আমাদের স্বপ্ন আর প্রগতির লক্ষ্য কি পূরণ হয়ে গেছে?

বিগত একদশকে আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশ অবকাঠামোগত আর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক কাজ করেছে, এটা সত্য। কিন্তু এতে করে কি আমরা বাংলাদেশকে যেই জায়গায় দেখতে চাই, নিয়ে যেতে চাই সেই সকল লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে? তাই কি আমরা ভোট দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি না?

এমন ভেবে থাকলে আবার পিছিয়ে যাওয়ার শুরুটা করে ফেলব আমরা। আমরা নৈতিক উন্নয়ন, উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার স্বপ্ন, জবাবদিহি, সমাজের প্রতিটা শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রেণি উন্নয়নসহ এমন আরও অনেক অসম্পূর্ণ  স্বপ্ন রয়ে গেছে। আমরা হয়তো মাসলো সোপানের মৌলিক চাহিদ গুলো পূরণ করতে পেরেছি, কিন্তু সোপান তো সেখানেই শেষ না। এর পরের ধাপগুলো হচ্ছে শ্রেণি উন্নয়ন, স্বীকৃতি, সম্মান, জীবনমান উন্নয়ন। দেশ সমাজের প্রতিটা মানুষ তার ভাগের পার ক্যাপিটা আয়ের সমান ইনকাম করতে পারার আগপর্যন্ত আমাদের চাহিদা আর স্বপ্ন থেমে যাওয়া চলবে না। আমাদের মুক্ত করতে, আমাদের উন্নত করতে, আমাদের সচ্ছল থাকার স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ লক্ষ মানুষ, নির্যাতিত হয়েছে লক্ষ মা-বোন, পরিবার শুদ্ধ নির্মমভাবে হত্যা হয়েছেন বাঙালি জাতির রূপকার বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতারা। এতো সব আত্মত্যাগ এখানেই থেমে যাওয়ার জন্য না।

  • ভোট হোক দায়বদ্ধতার দাবিতে
  • ভোট হোক সামাজিক ন্যায়বিচার সুশাসনের দাবিতে।
  • ভোট হোক ন্যায্যতা নিশ্চিত বৈষম্য নির্মূলের দাবিতে
  • ভোট হোক জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের দাবিতে।
  • ভোট হোক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন আর প্রগতির দাবিতে।

ভোট দেওয়ার জন্য মার্কার উপস্থিতি কেন জরুরি?

এই যে দাবির জায়গাগুলো, এই যে আরও চাহিদার জায়গাগুলো, এই যে সমাজতন্ত্র গণতন্ত্রের নিয়ামকগুলো, সেগুলো নিশ্চিত করতে পারে শুধুমাত্র ভোট প্রয়োগ। যদি মার্কা বিশ্বাস করেন, তাহলে মার্কায়, যদি মার্কা বিশ্বাস না করেন তাহলে ব্যক্তিকে। যেই ব্যক্তি আপনার চাহিদাগুলো, দাবিগুলো জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে পারবে। 

কেন দুই একটি মার্কার অনুপস্থিতি বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের স্বপ্ন চাওয়াগুলোকে বাধাগ্রস্ত করবে? আমরা যদি মনে করি ট্র্যাক প্রতীকে যিনি দাঁড়িয়েছেন, তিনি আমাদের দাবিদাওয়া পূরণে ভূমিকা রাখতে পারবেন তাহলে তাকে দেব ভোট। যদি মনে করি বিগত এক দশকে উন্নয়নের সোপান নৌকার কোন ভুল আছে, তাহলেই আমার ভোটই সেই ভুল ধরিয়ে দিতে পারে, সেক্ষেত্রে আমার ভোট হবে নৌকার বিরুদ্ধে। হোক সেটা কোন রাজনৈতিক দল বা স্বতন্ত্র ব্যক্তি। ভারতের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের চেয়ে স্বতন্ত্রপ্রার্থী অনেক বড় ভূমিকা রাখে সংসদে। আমার প্রার্থী যদি হয় আমার দাবি দাওয়ার পক্ষের লোক এবং নতুন সরকারের গঠন করতে পারে, তাহলে তো ভোট দিবই, কিন্তু আমার প্রার্থী যদি সংসদে বিরোধী পক্ষে থেকেও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে, চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে সেটাও হবে গণতন্ত্র রক্ষার সবচেয়ে বড় নিয়ামক।

হয় আমি উন্নয়নের পক্ষে থাকতে চাই, নয়তো সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য চ্যালেঞ্জ জানাতে চাই বিরোধী চেয়ারে বসে থাকা আমার প্রার্থীর মাধ্যমে। আর সেটা নিশ্চিত করতে পারে আমার ভোট। যদি আমার প্রার্থী আমার চাওয়ার বাস্তব প্রয়োগ করতে না পারে, তাহলে আসছে নির্বাচনে তাকে বর্জন করে আরও ভালো কাউকে বেছে নেব। এই যে গ্রহণ আর বর্জনের ক্ষমতা, সেটা শুধু ভোটার হিসাবে আমার কাছেই আছে। আর এটাই সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক হাতিয়ার, যাকে ভয় পায় নির্বাচন করা প্রতিটি রাজনৈতিক দল নেতারা। কিন্তু আমরা কি পারছি সেই ভয়ের জায়গাটা তৈরি করতে? ভোটের প্রতি আমাদের নিষ্পৃহতা গাছাড়াভাব কি তাদের দায়মুক্তি দিচ্ছে না? যা ইচ্ছা তাই করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে না? এর দায় তো আমাদের ভোট না দেওয়ার মানসিকতা, এর ভয় আমাদের চ্যালেঞ্জ না জানানোর মানসিকতা, এর দায় আমাদের ভয় দেখাতে না পারার মানসিকতা।

ভোট দিতে না যাওয়ার অজুহাতগুলো কী কী

  • আই হেইট পলিটিক্স
  • সরকার তো ভালোই করছে, পরিবর্তনের কী দরকার
  • ভোট তো রাতেই হয়ে যাবে
  • ভোট দেওয়ার চেয়ে ছুটি উপভোগ করা উত্তম
  • আমার ভোট কেউ না কেউ দিয়েই দেবে\
  • ব্যালটে তো আমার পছন্দের মার্কা নাই।

এই অজুহাত দিয়ে আমরাই যখন সরকারের সিদ্ধান্ত আর পরিকল্পনার সমালোচনা করি তখন সেটা দ্বিচারিতা হয়ে যায়, ভণ্ডামি হয়ে যায়। যেই সিদ্ধান্ত আর পরিকল্পনার অংশ হওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা সেই সুযোগ গ্রহণ করিনি, সেখানে সেই সিদ্ধান্ত আর পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথাই হওয়ার কথা না। 

আমাদের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা, ক্ষমতাসীনদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর