সহিংসতা এড়াতে দলীয় কঠোর অনুশাসন জারির এখনি সময়

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-03 21:27:11

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে সহিংসতামুক্ত একটি পরিবেশ সমকালীন বিশ্বে খোঁজে পাওয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উন্মত্ত সমর্থকরা যেভাবে ক্যাপিটাল হিলে বীভৎস হামলা চালিয়েছিল তাতে শান্তিপূর্ণ পন্থায় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনের গুটি কয়েক দৃষ্টান্তও ম্লান হয়েছে। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশের দেশসমূহে ‘শান্তিপূর্ণ অবাধ অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের আকাঙ্খা খুব জোর গলার করার সুযোগ হয়তো নেই। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে জনগণের আকাঙ্খার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম দেশে সহিংসতার রাজনৈতিক পরম্পরা থেকে বেরিয়ে শান্তি ও সহাবস্থানে সংস্কৃতিকে বরণ করে নিতে আগ্রহী। আমরা সাম্প্রতিক মাসগুলিতে বিরোধী দলগুলির সরকার বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ততার যে ঘাটতি লক্ষ্য করেছি এবং গণমাধ্যমে তরুণ সমাজের যে প্রতিক্রিয়া শুনেছি-তাতে সহিংসতাকে জায়গা দিতে তারা নারাজ। আমরা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে একটি সার্বভৌম স্বাধীন ভূখণ্ড রচনা করেছি। এখানে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে’ এই প্রবৃত্তি বহুলাংশেই কাজ করে।

আমরা আসন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিএনপি কিংবা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর আগামী ৭ জানুয়ারি (২০২৪) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করা নিয়ে দলগুলির নিশ্চয়ই নিজস্ব মত থাকবে। দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের সমমনা দলসমূহের নির্বাচনে না আসার ফলে নির্বাচনী মাঠে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সেই ঘাটতি লাঘবে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী যে কাউকে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ করার প্রয়াস নেওয়া হয়। শুরু থেকেই এই ধারণাটি নিয়ে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে খোদ আওয়ামীলীগের অভ্যন্তর থেকেই। আঁচ করা যাচ্ছিল যে, দলীয় অন্তর্কোন্দল এই নির্বাচনী কৌশলে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

আমরা লক্ষ্য করেছি, এই ঘোষণার পর থেকেই দেশের নানা প্রান্তে সংঘাতের প্রবণতা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা জনমানসে ভীতি ছাড়া কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনি। একদিকে, সরিকার বিরোধীদের লাগাতার অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিতে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ চলেছে। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে রেললাইন উপড়ে ফেলে আস্ত ট্রেনকে ইঞ্জিনসহ লাইনচ্যুত করার মাধ্যমে কত মানুষের জীবনকে যে বিপন্ন করার ঘটনা ঘটেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

বাঙালিরা নেহায়েতই স্মৃতিভ্রষ্ট জাতি, নইলে সাম্প্রতিক দশকে হিংসাত্মক রাজনীতির নামে যে পরিমাণ তাজাপ্রাণ নিয়ে নেওয়ার নারকীয়তা চালানো হয়েছে, তার পরেও তথাকথিত এই রাজনীতিবিদদের সামান্য অনুশোচনা নেই, কিংবা তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর নজিরইবা কোথায়? একে অন্যের কাঁধে দোষ চাপিয়ে হিংসাত্মক এই প্রবণতার পরম্পরা যেভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের রাজনীতিকরা, তাতে জনগণের রুদ্ররোষে তাদের ছারখার হয়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু সর্বংসহা এই জাতির জাতীয় জীবনে এই অপতৎপরতা চলতেই থাকে, আমরা সহ্য করেই যেতে থাকি।

এই বাস্তবতাকে এক পাশে সরিয়ে তবু আমরা আশায় বুক বেঁধে বলতে পারি যে, আসন্ন নির্বাচনের মাত্র হাতেগোণা কয়েকটি দিন পূর্বে নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকা দলগুলির শীর্ষ নেতৃত্ব যদি মনেপ্রাণে চলমান সংঘাতকে ‘না’ বলতে পারতেন তবে অবস্থার আমূল পরিবর্তন কোন সুদূর পরাহত বিষয় ছিল না। নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি পরস্পরকে ঘায়েল করার প্রবণতাকে পরিহার করে রায়ের জন্য ভোটারদের প্রতিই আস্থা রাখতে পারতেন তবেই আমরা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতাম।

আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে যতদূর ধারণা পাওয়া যায়, তাতে আমরা বলতে পারি, যদি কেনা তারা নির্বাচনে লড়াইয়ে জেতার জন্য যতটা প্রচেষ্টা চালান, ঠিক জনগণের জানমালের ক্ষতি না করার দিকে ততোটাই নিবেদিত থাকতেন; তবে বার বার নির্বাচনী হিংসার আগুনে বহু প্রাণ ঝরে যাওয়া ঠেকানো কঠিন হতো না। কিন্তু আমরা দেখে আসছি, রাজনীতিবিদদের এই প্রতিজ্ঞা মোটেই জোরাল নয়।

আমরা ভোটের প্রাক্কালে নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকা দলগুলির প্রধানদের প্রতি আকূল আবেদন আবেদন রেখে বলতে চাই, আপনারা নিজ নিজ দলের নেতাদের প্রতি এক কঠোর সাংগঠনিক অনুশাসন প্রেরণ করুন, এই সহিংসতায় যেন আর একটি প্রাণ ঝরে না যায়। প্রয়োজনে গেলোযোগপূর্ণ প্রতিটি আসনের নেতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে দলীয় প্রধানের আজ্ঞা প্রেরণ করুন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এই বিষয়ে তাঁর এই সময়ের কিছু মূল্যবান সময় ব্যয় করে প্রত্যক্ষভাবে দলীয় কোন্দল মেটাতে প্রয়াসী হন-নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়-এতে ফল আসবে। বহু মানুষের হতাহতের শঙ্কা হ্রাস পাবে। নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকা অন্যদলগুলিও তখন এই চর্চার অনুসরণ করবে। অন্তর্কোন্দল মেটানোর একটি শক্তিশালী প্রচেষ্টা নেওয়ার অনেক বিলম্ব হয়েছে বটে কিন্তু শেষ সুযোগটি এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর