টেলিগ্রাফের ‘রেড লাইন’ টানার প্রবর্তনা ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বাস্তবতা

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম | 2023-12-31 19:36:08

 

নিকট প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি ও পারিপার্শ্বিক উত্তাপ না চাইলেও অপরপ্রান্তে এসে পড়ে, এটি জানা কথা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরম্পরায় এগিয়ে চলা বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এই বিবেচনার বাইরেও অনেক দৃষ্টিকোণ রয়েছে। স্ব-স্ব দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও এই দুই দেশের সম্পর্ক বিশ্বের অপরাপর দেশসমূহের চেয়ে স্পষ্টতই স্বতন্ত্র। সাম্প্রতিক দশকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ যে দিকেই ধাবিত হোক না কেন, কিংবা সম্পর্কের নতুন যেই চ্যালেঞ্জই আসুক, বাংলাদেশ ও ভারত এটি সার্থকভাবেই মোকাবিলা করতে পেরেছে। এটি অত্যন্ত বাস্তব সত্য যে, সময়ের সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত যে পরিবর্তন সূচিত হয়, সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশ ও ভারতও নানা সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুই দেশের পরারাষ্ট্র নীতিতে এই সম্পর্কের জায়গাটি অপরিবর্তিত থেকেছে সচেতন বোধ থেকেই।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন খুবই সন্নিকটে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠায় বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের একটি তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে। বিশেষ করে, পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিশেষ তৎপরতার ফলশ্রুতিতে দেশটির অন্য প্রতিদ্বন্ধিরাও কমবেশি একটি অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নিকটতম বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি এবং উন্নয়ন অংশীদার ভারতের কাছে বিষয়টির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অন্যদেশগুলোর চেয়ে বিস্তৃত ও ভিন্নতর। ইতিমধ্যে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বলা হয়েছে, তারা মনে করে বাংলাদেশের জনগণই তাদের সরকার নির্বাচন করবে এবং তারা ‘স্থিতিশীলতা’র পক্ষে। এই কুটনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিরোধী দল বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায় থেকে ভারতের সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। বিএনপি নেতারা বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনগুলোতে ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে এটি জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান বলে বর্ণনা করেছেন।

আমরা লক্ষ্য করে থাকব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উত্তাপ যাই হোক না কেন-ভারতীয় শীর্ষ গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের স্বতন্ত্র বিদেশনীতি অনুসরণের চেষ্টা করে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর সময় থেকেই। কিন্তু গেল ২৭ ডিসেম্বর (২০২৩) ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ’র এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থান নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছে। ওই নিবন্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ তুলে ক্ষমতাসীন দলের একপেশে নির্বাচন প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছে। নিবন্ধে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে পীড়নের অভিযোগ তুলে ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে ‘রেড লাইন’ টানার সময় এসেছে বলে এক ধরণের ব্যাখ্যা দাড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের গত ৫ দশকের রাজনীতির যে ভাঙাগড়া চলেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ, ভারতবিরোধী পাকিস্তানি ভাবাদর্শের উত্থান, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতবিরোধী আগ্রাসনে সহায়তা দান, উত্তর-পূর্ব ভারতে অস্থিরতা সৃষ্টিতে মদদ, সন্ত্রাসীগোষ্ঠী উলফাকে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের সুযোগদান, দশট্রাক অস্ত্র প্রসঙ্গ, সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলোৎপাটনের অপচেষ্টায় যে রাজনৈতিক শক্তির সংশ্লিষ্টতা নানা সময়ে প্রমাণিত হয়েছে, তা নিয়ে দ্য টেলিগ্রাফের সম্পাদকীয় নিবন্ধে কোন উল্লেখ নেই। আমরা সাম্প্রতিক বছরে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বাংলাদেশ বিষয়ে একটি উক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি, যেখানে তিনি বলবার চেষ্টা করেছেন-বাংলাদেশের মতো বিশ্বস্ত প্রতিবেশী থাকার কারণেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে ভারত সরকার স্বস্তিতে রয়েছে এবং প্রতিরক্ষা খাতে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে না। রাজনৈতিক কারণে ভারতের দলগুলির মতভিন্নতা থাকলেও এই বিষয়ে তারা সকলেই একটি অভিন্ন অবস্থানে রয়েছেন।

আমরা পত্রিকাটির ওই নিবন্ধে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের প্রতি ভারত সরকারের নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যেখানে বলার চেষ্টা করা হয়েছে দলটির সঙ্গে তাদের সরকার কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এখানে আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের স্বাচ্ছন্দের যে প্রশ্ন, সেটি আদর্শিক জায়গাতে অভিন্ন সংহতির ফলশ্রুতিতে। আমরা লক্ষ্য করব, কেবল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই নয়; অভিন্ন সংহতির জায়গাতে ভারত অপরাপর অনেক দল ও বহু ব্যক্তির সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক রেখে চলে। এই দৃষ্টান্ত কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বের বহু দেশেই এই প্রবণতা বিরাজ করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি কেন অংশ নেয়নি? আমরা যদি মোটাদাগে লক্ষ্য করি তবে দেখব, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্তযুক্ত দাবিতে উচ্চকণ্ঠ থেকেছে পুরো বছরজুড়ে, তাতে দলটির অভ্যন্তরেই নানা মতভেদ পরিলক্ষিত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দলটির তৃণমূলের অগণিত নেতাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখার পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন। এমনকি দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের পন্থা নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তার মানে দাড়াচ্ছে, সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপি নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত। অপরদিকে, চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে দেশজুড়ে যে ব্যাপক ভাঙচুর, বাস-ট্রেনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটছে, তাতে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার দাবি করছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা। ফলে নাশকতার মামলায় বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতা-কর্মীরা আসামি হচ্ছেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্য যে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের উপর বহুলাংশে নির্ভর করে তা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত। সেখানে নাশকতার পরও দলটির লাগাতার কর্মসূচি তাদের দেশ ও জনগণের প্রতি দায়িত্বহীনতাকেই প্রকট করে তুলেছে। মোটাদাগে, বিএনপি’র নেতৃত্বের সংকট কিংবা আন্দোলনের ব্যর্থতায় ক্ষমতাসীনরা বাড়তি সুবিধা পেয়েছে, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন, অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্রমাগত বৈশ্বিক চাপের মুখে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে যেসব পদক্ষেপ নিতে হয়েছে আস্থা সৃষ্টিতে সেই জায়গাতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচনে না আসা তাদের অদূরদর্শিতারই পরিচয় বহন করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সময়ের সঙ্গে যে পরিবর্তন এসেছে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে তার সঙ্গে অভিযোজন করতে না পারার ফল যেমন দলের অগণিত নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বিরূপ প্রভাব ফেলে তেমনি তাদের মাঝে চরম হতাশায় দেশের গণতান্ত্রিক পরম্পরাও বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা বলতে যা বোঝায় তা অনেকটা এরকম বলেই সংশ্লিষ্টদের মূল্যায়ন। সেই জায়গা থেকে বন্ধুপ্রতীম দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নির্মোহ ও বাস্তবানুগ মূল্যায়নই প্রত্যাশিত। কেননা বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান মৈত্রীময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে পরম্পরা রয়েছে তা বিনষ্ট হলে দুই দেশের জন্যই তা কেবল অকল্যাণ বয়ে আনবে না, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যও তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর