নির্বাচন হোক নির্বিঘ্নে

, যুক্তিতর্ক

তারাপদ আচার্য্য | 2023-12-29 16:52:27

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি দিন বাকি নেই। এরই মধ্যে জোরেসোরে শুরু হয়েছে প্রচার-প্রচারণা। প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, বিজয়ী হওয়ার আশীর্বাদ চাইছেন। প্রার্থীর সাথে সাথে রয়েছেন সমর্থকেরা। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে মহল্লার অলিগলি। দেওয়ালের গায়ে সাটানো হয়েছে পোস্টার। পাটের দড়িতে দোল খাচ্ছে পোস্টার। মোড়ে মোড়ে মাইকে বাজছে নির্বাচনী গান। চারদিকে কেমন উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে। ঠিক শীতকালের সকালের মিষ্টি রোদের মতো। ভোট কেন্দ্রে যাওয়া, নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া তো একটা উৎসব বলেই মনে করেন জনগণ। ভোট দেবার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে এখন তারা অপেক্ষা করছেন আসন্ন ভোটের দিনের জন্য।

ভোটের এই উৎসব উৎসব আমেজ দেখে ছোটবেলার দুর্গা পূজার কথা খুব মনে পড়ে যায়। কৈলাশ ধাম থেকে মর্ত্যে দেবী দুর্গার আগমনের অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ শরৎকাল শুরু হলেই সবার ভেতরে একটা সাজ সাজ রব পরে যেত। মনে খুশির বাতাস দোলা দিয়ে যেত। মুড়ি-মোয়া-নাড়– তৈরি শুরু হতো। ঘরে আসতো নতুন জামা-কাপড়। হাতের আঙুল গুনে দিন গুনতাম আর কয়দিন বাকি আছে পূজা শুরু হতে। কতই না কাঙ্খিত ছিল সেই পূজার দিনগুলি! আজ কেন জানি সেই ছোটবেলার আমেজটা এই বুড়ো বয়সে এসে বুকের ভেতর উথাল-পাথাল করছে। কিন্তু পূজার সাথে নির্বাচনের সময়ের বড় একটা ফারাক আছে। দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর আর নির্বাচন হয় পাঁচ বছরের ব্যাবধানে। আমি যে এই দেশের নাগরিক তা প্রমাণ করার এটা একটা মহাসুযোগ।

এবারের নির্বাচনের দৃশ্যপট বরাবর নির্বাচনী দৃশ্যপটের চেয়ে অনেকটা আলাদা। এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে যেমন অনেকে প্রার্থী হয়েছেন, তেমনি অসংখ্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন কোনো বাধা-বিঘ্ন ছাড়া। আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, বড় নেতা এবার দল থেকে মনোনয়ন পাননি। নির্বাচনী মাঠে তারা এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এর ফলে অন্যান্য বারের তুলনায় সাধারণ জনগণ ভোট দিতে ভোটার কেন্দ্রে আসবেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাই এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এখনো পর্যস্ত কোথাও কোনো বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তাই এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।

দেশের নির্বাচন নিয়ে এবার যে জলঘোলা হয়েছে তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এই ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চেয়েছে কতিপয় দেশ ও আমাদের দেশের কুচক্রীরা। বিদেশিরা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন অজুহাতে সরকারের ওপর তাদের চাপানো মতামতের প্রতিফলন দেখতে চেয়েছে। সরকারকে নাজেহাল করার বহু চেষ্টা করা হয়েছে। হুমকিÑধামকি দিতেও তারা পিছুপা হয়নি। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে সাহসের পরিচয় দিয়েছে। কোনো পরাশক্তির তোয়াক্কা না করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। তারা দৃঢ়চিত্তে জানিয়ে দিয়েছে- দেশ আমাদের, সিদ্ধান্তও আমাদের। আমরা কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় পাই না। এটার জন্য সরকার প্রশংসার দাবিদার। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে আমরা সত্যি স্বাধীন হয়েছি বলে মনে হচ্ছে। আমরা সত্যি  দেশের স্বার্থে কণ্ঠ উঁচু করে কথা বলতে পারি তা সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন।

১৯৭২ সালে আমাদের দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন সদ্য প্রয়াত সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। এ দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের পেটের ভাত আমরা নিজেরাই জোগাড় করতে পারি। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পঞ্চম থেকে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। আমাদের প্রয়োজনের ৯৭% ওষুধ আমরা নিজেরাই তৈরি করতে পারি। আমরা পোশাক শিল্প রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি। চামড়া বিদেশে রফতানি করছি। চা রফতানি করছি। তাহলে কি করে আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি হলাম!

বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমরা নিজেদের ও যৌথ অর্থায়নে তৈরি করেছি পদ্মাসেতু (রেল প্রকল্পসহ), কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে চলাচলের জন্য বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক, মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক ইত্যাদি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া শেষ করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এসব সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে।

আমাদের দৃষ্টি অনেক দূর, চোখে অনেক স্বপ্ন। আমাদের এ স্বপ্ন সফল হবেই। এই উন্নয়নের ধারাকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। কিন্তু বাধা দেবার অনেকেই চেষ্টা করবে। দেশের বাইরেও শত্রুর অভাব নেই। দেশের ভেতরও আমাদের শত্রু আছে। তা না হলে দেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিদেশিদের সাথে আঁতাত করে একটি রাজনৈতিক শক্তি দেশের ক্ষমতায় আসার অপচেষ্টা করতো না। স্বাধীন দেশের জনগণ এমন অপতৎপরতা কিছুতেই মেনে নেবে না এবং মেনে নেয়ওনি। ‘খাল কেটে কুমির আনা’ -এই প্রবাদটি আমাদের সমাজে বহুযুগ ধরে প্রচলিত আছে। দেশের স্বার্থ বিবেচনা না করে, জনগণের কথা না ভেবে ঘরে যদি খাল কেটে যদি কুমির আনি তাহলে দেশের জন্য সেটা হবে অশনি সংকেত। আমরা ভুলিনি ইংরেজ শাসনামলের দুর্বিষহ দিনগুলির কথা! আমরা ভুলিনি পাকিস্তানি হায়নাদের বর্বরতার কথা!

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে গোছানোর আগেই স্বপরিবারে শহীদ হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গেলেন বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বোন শেখ রেহেনা। এরপর অন্ধকার পথে হাঁটতে হাঁটতে, স্বৈচারীরর শাসন পেরিয়ে ক্ষমতায় এলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। আবার হলো ছন্দপতন। আবার বন্ধুর পথে চলা। তারপর জনগণের রায়ে দেশে প্রতিষ্ঠা পেল সুশাসন।

বিগত দিনগুলোতে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথ ধরে রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। কুড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রশংসা। এই ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগসহ বেশ কিছু দল আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। জনগণের প্রত্যাশা, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হবে। কিন্তু কোণঠাসা অংশগ্রহণ না করা অপরাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে শঙ্কা একটা থেকেই যায়। এরা নির্বাচনী উৎসবকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি; ভবিষ্যতেও পারবে না। এদের দ্বারা সহিংসতার আশঙ্কা অমূল নয়।

আমরা সেই বাঙালি যারা নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করি। তবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে এখনো উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এরই মধ্যে প্রার্থী ও প্রার্থীর সমর্থকেরা ছোট-খাটো নির্বাচনী বিধিমালা লঙ্ঘন করলেও কোথাও বড় ধরণের সহিংসতার কথা শোনা যায়নি। তবে নির্বাচনকালীন সময়ে কোনো জায়গায় সহিংসতা হলে তা কঠোর হাতে দমন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই। জনগণ চায়- সুষ্ঠু, আবধ নির্বাচন তাদের তত্ত্বাবধানেই হবে। তাই আইন-শৃংখলা বাহিনীকে সবসময় প্রস্তুত রাখতে হবে যাতে উৎসবমুখর ভোটের প্রচারণা যেন সহিংসতার শিকার না হয়।

নির্বাচনকে ঘিরে কিছু অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে আমার জীবনকালে অনেক নির্বাচন দেখেছি। নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের ওপর যে অমানবিক নির্মম নিষ্ঠুরতা নেমে আসে সেটাও প্রত্যক্ষ করেছি। তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, জামি-জমা দখল করা হয়। ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য তাদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়, দোকান-পাট লুট করা হয়। অনেক সময় তাদের বাধ্য করা হয় দেশ ত্যাগ করার জন্য। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের নির্দিষ্ট একটি দলের ভোটব্যাংক বলে মনে করে থাকে। আমি বাস্তবতাকে উপেক্ষা না করে বিষয়টা খোলাখুলি বললাম। আসন্ন নির্বাচনে দেশের যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা যেন সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

নিরপেক্ষ, অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবার অনুষ্ঠিত হবে বলে জনগণ মনে করেন। তবে রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করছে তাদের কথাও মনে রাখতে হবে। শঙ্কার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ভোটের মাঠ অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে এ কথাও মনে রাখতে হবে। ভোটার ও নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোর যথেষ্ট নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। ভোটের পর বিদেশিদের অপতৎপরতা কথা মনে রাখতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ধৈর্য, মনোবল ও সাহস রাখতে হবে। দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে প্রত্যেক নেতা কর্মীকে নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে জনগণের কথা ভাবতে হবে। দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে।

লেখক: কলামিস্ট প্রাবন্ধিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর