দলীয় এই সহিংসতা কি এড়ানো যেত না?

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2023-12-25 18:47:28

আগামী ৭ জানুয়ারি (২০২৪) অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ২৬ নভেম্বর (২০২৩) দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পূর্বে গণভবনে মনোনয়ন প্রত্যাশী সকলকে ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেদিন দলীয় প্রধান সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করেন নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে মনোনয়ন না পাওয়া দলের যে কেউ প্রার্থী হতে পারবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তকে দলের অনেকে প্রকাশ্যে সাহসী ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বললেও ভেতরে ভেতরের উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছিল। গণমাধ্যমগুলোতে নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া অনেক নেতা, এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দলীয় অন্তর্কোন্দল যে আরও বিস্তার লাভ করবে এ আশঙ্কা আগেই করা হচ্ছিল। অবশেষে সেই আশঙ্কা বহুলাংশেই বাস্তব হয়ে উঠল।

গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত গত কয়েক দিনের খবরে জানা যাচ্ছে, সব ক’টি সংসদীয় আসনে না হলেও অধিকাংশ আসনে দলীয় অন্তর্কোন্দলে ‘রক্তারক্তি’ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, কর্মী-সমর্থকদের রক্তাক্ত জখমের খবরও মিলছে হরহামেশা। ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ-৪ আসনে অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষে রফিকুল ইসলাম (৫২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। দেশজুড়েই হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল (২৪ ডিসেম্বর ২০২৩) আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সহিংসতায় জড়ানোদের সতর্ক করে দলীয় প্রধানের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি এও উল্লেখ করেন যে, সহিংসতা করলে নির্বাচন কমিশন যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে দল তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।

আজ সোমবার (২৫ ডিসেম্বর ২০২৩) মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের গণসংযোগে সংঘর্ষ ও ছুরিকাঘাতের ঘটনায় ৭ ছাত্রলীগ নেতাকে স্থায়ী বহিষ্কারের খবর দিয়েছে গণমাধ্যম। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনানের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের বহিষ্কার করা হয়। বাস্তবতা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের এই ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র সামনের দিনগুলিতে বহুলভাবে ব্যবহারের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে বলেই মনে হয়। সংঘাতের এই প্রবণতা যে বৃদ্ধি পেতে পারে, এই আশঙ্কা তো গেল ২৬ নভেম্বর ২০২৩ থেকেই প্রবল হয়ে উঠছিল।

তাহলে দলের হাই কমাণ্ড কি সম্ভাব্য এই বিশৃঙ্খলা এড়াতে এতদিন কোন ভাবনা চিন্তাই করেনি? নাকি অনিবার্যতাকে এড়ানোর বিকল্প খোঁজে পায়নি? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, স্ব-স্ব নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে দলের নেতারা হয়তো এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে সামগ্রিক শৃঙ্খলা বিধানে কৌশল গ্রহণের পর্যাপ্ত সময় তারা বের করে উঠতে পারেননি। কিন্তু ক্ষমতা ও আধিপত্য রক্ষার লড়াইয়ের তীব্রতা যে হারে বেড়েই চলছে, তাতে বহু মানুষের হতাহতের আশঙ্কার সঙ্গে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির উদ্বেগও কাটছে না। এতে করে নির্বাচনে সহিংসতার যে পূর্বাপর অপ-সংস্কৃতি কয়েক দশক ধরে দেশের সাধারণ মানুষকে নির্বাচনকালীন সময়ে উৎকণ্ঠার মাঝে রেখেছে, আমরা সেখান থেকে সামান্যতম উত্তরণও ঘটাতে পারিনি-এটি দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বলা যাবে।

আমরা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপিসহ সমমনা অন্যান্য দলের নেতাদের যে বক্তব্য বা অভিযোগ গণমাধ্যমে শুনে আসছি তাতে তারা বার বার বলবার চেষ্টা করছেন যে, ক্ষমতাসীন দল ফের একটি পাতানো নির্বাচনে পথে হাটছে। বিরোধীদের এই অভিযোগ আমলে না নিয়েও যদি বিবেচনা করা যায় তবুও দলীয় এই অন্তর্কোন্দলে সাধারণ মানুষের মাঝে নিরাপত্তার যে নতুন উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে, তা নিরসনে যথেষ্ট পদক্ষেপ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে দেখা যায়নি।

আমরা লক্ষ্য করছি, ঢাকায় গেল ২৮ অক্টোবর বিএনপি আহুত সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা অন্য দলগুলির হরতাল-অবরোধকে ঘিরে এমনিতেই জনমনে যথেষ্ট উদ্বেগ বিরাজ করছে। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের সঙ্গে গেল কয়েক সপ্তাহ রেললাইন উপড়ে ফেলে কিংবা ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা চলমান সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এবং বলা হচ্ছে, এই বন্ধ করার তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। সাধারণ জনগণের সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যাতায়াতের বাহন হিসেবে ট্রেনের নির্ভরযোগ্যতাকেও অনাস্থায় পর্যবসিত হওয়া নিঃসন্দেহে আরও শঙ্কা বাড়িয়েছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অপরাধীরা আইনের আইনের আওতায় এসেছে। অচিরেই এই অপতৎপরতা বন্ধ হবে। আস্থা ফিরে আসবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তারা দ্রুততার সঙ্গে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার খবর দিয়েছে। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক দলগুলির নেতাকর্মীদের কাছ থেকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করতে পারি। নির্বাচন বানচালের ‘অগণতান্ত্রিক অপচেষ্টা’র সঙ্গে নির্বাচনমূখী দলগগুলির; বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কেবলমাত্র মসনদের লড়াইয়ে জিতবার প্রবণতায় সংঘাতে জড়ানোর দায়িত্বহীন আচরণও নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত। দলীয় অন্তর্কোন্দলে হানাহানির অনিবার্যতাকে বিবেচনায় নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিশেষ কৌশল অনেক আগেই নেওয়া যেতে পারত। এতে সহিংসতায় বহু মানুষের হতাহতের ঘটনা যেমন নাও ঘটতে পারতো, তেমনি খানিকটা উন্নতি হতো সাধারণের মাঝে রাজনীতি নিয়ে বিরূপ ধারণারও।

এ সম্পর্কিত আরও খবর