৩ হাজার টাকার AI সফটওয়্যার চোখ রাঙাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনকে

, যুক্তিতর্ক

শরিফুল হাসান সুমন | 2023-12-17 12:35:24

গত নভেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদিতে ভ্রমণের সময় মদিনায় যান। সেই মদিনা সফরের হোটেল লবির একটি ভিডিও, যেখানে শেখ হাসিনাকে দেখা যায় জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানাতে, সেই ভিডিওতে ‘ভুয়া-ভুয়া’আওয়াজ করে সমবেত জনসাধারণের দেয়া দুয়োধ্বনি সম্বলিত একটি ভিডিও অনলাইন প্লাটফর্মে ভাইরাল হয়। এএফপি জানিয়েছে, এই ভিডিও এডিট করা। যদিও বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত এই ভিডিও ফুটেজে কোন আওয়াজ যোগ করা হয়নি।

অনলাইনে ১ দিনে ৯৬ হাজার ভিউ পাওয়া এই ভিডিওটি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি বিশ্লেষণ করেছে, এবং সেই বিশ্লেষণের উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে গতকাল ১৫ ডিসেম্বর। রিপোর্টে বলা হয়েছে: গুগলে খুঁজে এই একই ভিডিওর মতো একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যা সেই একইস্থানে থেকে ধারণ করা কিন্তু অন্য একটি অ্যাঙ্গেল থেকে। ভিডিওটির বাংলা ভাষায় লেখা শিরোনাম: "প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মদিনার হিলটন হোটেলে পৌঁছেছেন"।কিন্তু উক্ত ভিডিওটিতে কোন শ্রবণযোগ্য শব্দ তো নেইই, ফলে দুয়োধ্বনি থাকার প্রশ্নই আসে না। বিকৃত করা সেই ভিডিওটি যে সময়ে যে স্থানে ধারণ করা হয়েছে, সেই একই স্থান থেকে থেকে ধারণ করা ৩ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের অপরিবর্তিত এই ভিডিও ফেসবুকে হাওলাদার আব্দুল কালাম নামের একজন আপলোড করেছিলেন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে নীতিনির্ধারকরা উদ্বিগ্ন এআই এর ব্যাবহার করে ভুল ও মিথ্যা তথ্য সম্বলিত বিকৃত তথ্য প্রচার নিয়ে। আগামী বছর সারা বিশ্বে ডজনখানেক নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এবং প্রায় প্রতিটি নির্বাচন AI জেনারেটেড ছবি ও ভিডিও দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। মাসে মাত্র ২৪ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার টাকার মতো) ফি দেওয়ার মাধ্যমে বিকৃত ছবি, ভিডিও ফুটেজ পরিবর্তন করে কি বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বিতর্কিত করা যাবে?

১৮ কোটি মানুষের দেশে তিক্ত ও ক্ষমতার মেরুকরণের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে জানুয়ারি মাসে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। এমন একটি দেশ যে দেশের ৯৮% মানুষ সম্ভবত পার্টিজান পলিটিক্সে অভ্যস্ত, যেখানে হাটে মাঠে চায়ের দোকানে, গৃহস্থালির আড্ডার বেশিরভাগটা জুড়েই থাকে বাংলাদেশের রাজনীতি আর নির্বাচন। এমন একটা দেশ যে দেশের বেশিরভাগ লোককে প্রভাবিত করতে পারা খুবই সহজ, কারণ অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষ অনলাইনে যা দেখে সেটাই বিশ্বাস করে। এমন প্রবণতা শিক্ষিত মানুষের মাঝেও দেখা যায়, যারা দ্বাদশ শতকের তোলা কাবা শরিফের কালার ছবিকে বিশ্বাস করে আর শেয়ার করে, কিন্তু যুক্তিতর্কের মাধ্যমে একবারও যাচাই করে দেখে না ক্যামেরার আবিষ্কার কবে হয়েছে আর রঙিন ছবির প্রচলন কবে থেকে শুরু হয়েছে।

বিগত দিনেও আমরা দেখেছি বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবরের কাটতি খুব বেশি। আর এতে লাইক ভিউ খুব বেশি পাওয়া যায়। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের নিয়ে বা রাজনীতি রাষ্ট্রনায়কদের প্রচারিত বিকৃত ছবিতে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যে থাকে রাজনৈতিক বিরোধিতা থেকে ট্রল করা বা মজা করা, কিন্তু বিষয়টা আর সেখানে আটকে নেই। এখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ছবি ভিডিও এবং বক্তব্য বিকৃত করা হচ্ছে ডিপফেইক এর মাধ্যমে। প্রাসঙ্গিক কারণে এমন কিছু ঘটনা উল্লেখ্য করা দরকার:

  • সম্প্রতি AI জেনারেটেড একটি ভিডিওতে দেখা যায় একজন টিভি উপস্থাপক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র ও তীক্ষ্ম ভাষায় তিরষ্কার করছেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনা সরকারের উপরে ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল। এই ভিডিওটি AI জেনারেটেড একটি ডিপ ফেইক ভিডিও, যা পরে সরানো হয়েছিল।
  • আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় বিরোধীদলীয় এক নেতা ফিলিস্তিনিদের প্রতি মুসলিম উম্মাহর তরফ থেকে সংহতি প্রকাশ করছেন এবং শক্ত ভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যেটা ছিল ডিপফেইক দিয়ে তৈরি করা।

বিভ্রান্তিকর AI কন্টেন্টের বিরুদ্ধে ক্র্যাক ডাউন করার জন্য প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতি জনসাধারণের চাপ বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ ২০২৪ সালে প্রত্যাশিত বেশ কয়েকটি বড় নির্বাচনের আগে AI নিয়ন্ত্রিত ছবি বা ভিডিও বিকৃতিকরণ বাড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে। যা খালি চোখে দেখে বোঝার কোন উপায় নাই যে এগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। একমাত্র প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া এই ভিডিওগুলো ধরার কোন উপায় নেই। এর প্রতিক্রিয়ায়, গুগল এবং মেটা সম্প্রতি নীতিমালা ঘোষণা করেছে, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন ডিজিটালভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা তা প্রকাশ করার জন্য প্রচারাভিযান শুরু করতে যাচ্ছে মেটা।

ডিজিটাল রাইট গবেষণা সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, যখন তাদের কাছে এআইয়ের মতো প্রযুক্তি এবং সরঞ্জাম থাকে, যা তাদের মিস ইনফরমেশন সম্বলিত ছবি বা ভিডিও তৈরি করতে সাহায্য করবে, তাহলে সেটা কত বড় স্কেলে হতে পারে সেটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় হুমকি হলো ছোট বাজারে যেখানে ভোক্তা বেশি কিন্তু প্রযুক্তির সহায়তা কম, সেখানে এই সকল AI দ্বারা পরিবর্তিত মিথ্যা বা প্রোপাগান্ডামুলক ভিডিও অনেক বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে পারে”। সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছিলাম এক অভিনেত্রী প্রতারিত হয়েছে একটি তথ্যের দ্বারা যে কলেজের মেয়েদের গলা কাটা হচ্ছে, দলবেঁধে ধর্ষণ করছে রাজনৈতিক দলের অফিসে। আর সেটা কী রকম প্রভাব ফেলেছিল তা আমরা সকলেই জানি। সেই তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার আগেই অঘটন যা ঘটার ঘটে যেতে পারে। কারণ একটা বিশাল সংখ্যক জনগণ যখন মিথ্যা বা ভুল তথ্য দিয়ে প্রভাবিত হতে হয়তো ২/৩ ঘণ্টা সময় লাগে আর সেটা দাবানলের গতিতে ছড়ায়, কিন্তু সত্য ঘটনা জানিয়ে তাদের বুঝিয়ে স্তিমিত করার প্রক্রিয়াটা আগায় অনেক ধীর গতিতে। চাঁদে যুদ্ধাপরাধী সাঈদিকে দেখা যায়নি, সেটা মানুষকে বোঝাতে সপ্তাহ দুই সময় লেগে যায়। কিন্তু ততদিনে পুলিশ হত্যাসহ বিশাল রকমের ম্যাসাকার হয়ে গিয়েছিল।

তথ্য প্রযুক্তির যুগে, তথ্যে অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা যেমন একটা দেশের দায়িত্ব, তেমনি মিথ্যা বা ভুল তথ্য যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেটাও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পরে। আমরা ২০২১ সালে আমেরিকাতেও দেখেছি মিস ইনফরমেশন কীভাবে নির্বাচনের ২ মাস পরে রায়টের সৃষ্টি করেছিল। যেখানে লাখে লাখে ট্রাম্প সমর্থকরা রাস্তায় নেমে এসেছিল, এবং পুলিশ আর সমর্থকদের সংঘর্ষে ম্যাসাকার হয়ে গিয়েছিল। শুধু একটি বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যের কারণে, প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা আমেরিকাতেও জনরোষের দাবানল থামাতে পারেনি।

এ বছরের শুরুতেও মার্কিন রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি একটি আক্রমণাত্মক এড প্রকাশ করে যেখানে AI জেনারেটেড ইমেজের দেখানো হয় বাইডেন প্রশাসনের প্রভাবে কী ধ্বংসপ্রাপ্ত এক অরাজক সমাজব্যবস্থা হতে যাচ্ছে আমেরিকায়, এর নাম ছিল “ডিস্পোটিয়া অব ফিউচার”। যা পরে বাইডেন প্রশাসন সরিয়ে ফেলে।

বাংলাদেশে, জানুয়ারির প্রথম দিকে নির্বাচনের আগে এই ভুল তথ্য একটি উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশকে ইন্ধন যোগাতে পারে। শেখ হাসিনা বিরোধীদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করছেন। হাজার নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা সমালোচকদের প্রভাবিত করছে ভোট কারচুপির সংক্রান্ত ও একতরফা বিষয়গুলোকে উসকে দিতে। আর যেখানে বাংলাদেশের নির্বাচকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য বাংলাদেশের উপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে আমেরিকার প্রশাসনের পক্ষ থেকে, রয়েছে ভিসা স্যাংশন, বাণিজ্য স্যাংশন জাতীয় হুমকি, এমন অবস্থায় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ আর বিতর্কিত করবার জন্য AI ব্যাবহার করার সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্র প্রস্তুত।

বিডি পলিটিকো, একটি অনলাইন নিউজ আউটলেট দ্বারা সেপ্টেম্বরে সোশ্যাল হ্যান্ডল এক্স (সাবেক টুইটার)-এ পোস্ট করা একটি ভিডিও, যেখানে "ওয়ার্ল্ড নিউজ" এর জন্য সংবাদ উপস্থাপক একটি স্টুডিও সেগমেন্ট উপস্থাপন করেছেন — এর সাথে যোগ করা হয় দাঙ্গার ছবি — যাতে তিনি মার্কিন কূটনীতিকদের বাংলাদেশিদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেন, নির্বাচন এবং রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য তাদের দায়ী করা হয়। ভিডিওটি লস অ্যাঞ্জেলস-ভিত্তিক AI ভিডিও জেনারেটর HeyGen ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।

এমন সস্তা AI জেনারেটেড সফটওয়্যার বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা, বিতর্কিত করা, এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল।   

এ সম্পর্কিত আরও খবর