বিজয়ের মাসেও প্রতিদিন নিচে নামছি কেন?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-12-15 16:35:14

 

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গত বেশ কয়েক বছর ধরে বেশ স্থিতিশীল ছিল। বিশেষ করে সরকার ও বিরোধী পক্ষগুলো নানা বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য প্রকাশ করে ঘরে-বাইরে, গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় টক-মিষ্টি, ঝাল কথা বলে বাগাড়ম্বর করলেও পরস্পর পরে দেখে নেব’খন অথবা ‘টিভি টকশো’-তে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আবার কোন কোন সময় নোট অব ডিসেন্ট ও বিবৃতি প্রদানের মধ্যে ক্ষান্ত দিতে দেখা গেছে।

ফলে বড় কোন সংঘাত বা সংঘর্ষ ঘটতে দেখা যায়নি। জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি ও হরতাল অবরোধ ইত্যাদি পর্যন্ত কোন ঘটনা গড়ায়নি। সবার মধ্যে সহনশীলতা থাকায় ‘যেভাবেই হোক- দেশের কল্যাণ হোক’এমন একটা ভাবধারা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত পাঁচ-ছয় বছর হরতাল, অবরোধ বন্ধ থাকায় দেশের অনেক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে এবং রাস্তাঘাটে চলাফেরায় জনমনে কিছুটা স্বস্থির ভাব ছিল।

কিন্তু হঠাৎ করে দেশের রাজনৈতিক সহনশীল অবস্থার মধ্যে চরম ভীতিকর অবস্থার বহি:প্রকাশ ঘটার সাথে সাথে নিমিষেই সবকিছু উবে গেছে। এই ভীতিকর অবস্থা তৈরী করার জন্য দায়ী কে বা কোন ঘটনা তা নিয়ে ইতোমধ্যে নানা কারণ উন্মোচন এবং তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমে গেছেন বিভিন্ন পক্ষগুলো।

নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হবার পর একটি বড় দলের মনোনয়ন বঞ্চিতরা বিভিন্ন জায়গায় স্বতন্ত্র সাইনেবোর্ডে জয়লাভের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।আচরণবিধি লঙ্ঘণ করে বেআইনীভাবে কে কত টাকা উড়াচ্ছেন তার সঠিক হিসেব নেবার উপায় বের করা কঠিন!

পাশাপাশি ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসের প্রতিবাদ সমাবেশের পর থেকে প্রধান বিরোধী শক্তিগুলোর হরতাল-অবরোধের মাত্রা আরো বেশী গতিপ্রাপ্ত হচ্ছে। নির্বাচন আয়োজনের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিগুলোর অসীম জেদের যাঁতাকলে ধ্বংস হচ্ছে দেশের অর্থনীতি এবং অর্থাভাবে চরম জীবন-যন্ত্রনায় নিষ্পেষিত হচ্ছে দরিদ্র মানুষগুলো। এই মাতোয়ারা মুহূর্তে তাদেরকে দেখার কেউ নেই।

একটি বৃহৎ জনসভার এক সপ্তাহ আগে থেকে বলতে শোনা গেছে ‘মহাসমাবেশ করে লাভ নেই, সেখানে ২০১৮ সালের হেফাজতের শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশের চেয়ে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।’বিশ্লেষকগণ বলছেন, বিএনপি-র শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ চলার সময় সেটাকে পন্ড করার জন্য কয়েক হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি বর্ষণ করে ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছিল। সাউন্ড গ্রেনেডের ভয়ংকর শব্দ ও ঝাঁঝালো কাঁদানে গ্যাসের প্রভাবে মহাসমাবেশে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে হতভম্ব হয়ে চারদিকে ছুটে পালানোর চেষ্টা করেছে। যে ঘটনা গোটা বিশ্ববাসী লাইভ প্রত্যক্ষ করেছেন। যাদের দায়িত্ব ছিল জনগণের জানমাল রক্ষা করার তাগিদে একটি সুশৃংখল মহাসমাবেশকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করা, তারা কেন আগ বাড়িয়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও ঝাঁঝালো কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়ে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করলেন সেটাই এখনও বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।

কারণ, এর পূর্বে গত কয়েক মাসে বিএনপি-র অনেকগুলো শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলোতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর হঠাৎ করে রাজনৈতিক উচ্চমহলের আগাম উস্কানীতে সেই বক্তব্যের বাস্তবায়ন করে ফেলেছে দেশের আইন শৃংখলা বাহিনীর কিছু উৎসাহী সদস্য। এমনকি সেই ঘটনা পার হবার ছয়দিন পরও দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের মুখ থেকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘বিএনপি-র নেতারা সামান্য সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শুনে সমাবেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, এখন গর্তে লুকিয়ে আছে’ইত্যাদি।’

কথা হলো- কেউ সহিংসতা ঘটাতে পারে তার জন্য অন্যকারো আগাম সহিংসতা ঘটিয়ে এমন কথার জবাব দেয়া কি দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট পহারাদারদের কাজ? এতকিছু ঘটছে তার প্রধান কারণ আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু যে কারণে আমাদের নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বে আগ্রহ তৈরী হয়েছে তা অনেকের নিকট জানা আবার অনেকের নিকট এটি একটি ‘ওপেন সিক্রেট।’আসল কথাটি হয়তো সবাই জানেন, বুঝেন, উপলব্ধি করেন কিন্তু প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এখানে যেসব জিনিষের অভাব তৈরী হয়েছে সেগুলো বহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছুঁয়ে দেখার উপায় নেই।

তাই কেউ কিছু বলতে গিয়েও বলতে চান না। তারা জেনে ফেলেছেন, এদেশে বেড়ায় ফসল খেয়ে ফেলে। যে সর্ষে দিয়ে নির্বাচনী ভূত-প্রেত তাড়ানোর কথা সেই সর্ষের দানার মধ্যে ভূতের গহীন আস্তানা বিরাজমান। সেসব আস্তানা নানা আর্থ-মনো:সামাজিক ও কঠিন উপাদান দিয়ে সুরক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়েছে।

কিছুদিন আগে ঢাকার কাওলায় ও মাতারবাড়িতে জনসভায় শোনা গেছে- ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন এদেশে হবে।’এটা জনসভায় বলা হলেও বাংলাদেশের কল্যাণের নিমিত্তে এখন দেশ-বিদেশ ভেদে সবার চাওয়া। মূল কথা হলো- জনগণ নির্বাচন চায়, কিন্তু যেনতেন নির্বাচন চায় না।

কেউ আসুক বা না আসুক ক্ষমতাসীনরা যে কোন প্রকারে নির্বাচন করতে মরিয়া। এজন্য নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হয়েছে।কেউ কেউ মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু ভেতরে দারুণ উদ্বেগ, অস্থিরতা বিরাজ করছে।কারণ তারা জানে প্রবাদে আছে, ‘ভোগের কিল মায়ে কিলায়, না হয় মাচা ভেঙ্গে পড়ে মাথায়।’

সেটা যাই হোক, কিন্তু এত জনপ্রিয়তা ও উন্নয়ন কাজের দাবীদার হয়েও কেন একটি যেনতেন মার্কা নির্বাচন করতে হবে? এজন্য ঘৃণ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে কেন গ্রেনেড ছোঁড়ার মতো জনভীতিকর কাজ করাতে হবে? অপরদিকে এর প্রতিক্রিয়ায় কতটা গাড়ি পুড়ালে, কতটা হরতাল ও অবরোধ ডাকলে জনসমর্থন বাড়বে বা কমবে? জনগণ আর কতটা নাকাল হতে থাকবে? আরও কতটা দ্রব্যমূল্য বাড়লে জনপ্রিয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে?

ক্ষমতাসীনদেরকে কতটা গ্লানি নেবার পর নিজের ভোট নিজে আয়োজন করতে হবে? নিজের নির্বাচনে নিজে নিয়ন্ত্রক থেকে কতটা অপবাদ নিয়েও মুখে হাসির চেষ্টা করে গণমাধ্যমের সামনে দাঁড়াতে হবে? এজন্য পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে নিজের অবস্থান বিসর্জন দিয়ে বাহিনীর উপর নির্ভরশীল থেকে ক্ষমতার জন্য হাপিত্যেশ করতে হবে?

এখনই মুখোমুখি বসার, কথা বলার পরিবেশ নেই। তাই পরে কি হবে তা বলাই বাহুল্য। এখন রাষ্ট্রশক্তি সাথে নিয়েও নিরাপত্তাহীনতার কথা যারা বলে বেড়াচ্ছেন তারা পরের পরিস্তিতি চিন্তা না করে ভুল করছেন। কারণ, রাষ্ট্রশক্তি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যে কোন নেতাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। তারা ভাবছেন, আমি আছি থাকব, থেকেই নির্বাচন করব। রাষ্ট্রশক্তি চিরদিনই আমার। তারা বড় ভুল করছেন। কিন্তু দেশ যদি দিন দিন কারো জেদের কাছে ডুবে যেতে থাকে তাহলে তাহলে এত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি কার জন্য কোথায় বাস্তবায়িত হবার সুযোগ পাবে?

রাষ্ট্রশক্তি বা রাষ্ট্রীয় পেশীশক্তিধারীরা নিজেরা নিজেদের লাভ-লোকসান হিসেব সব সময় বর্তমান ক্ষমতার সহযোগিতা করে। এসব রাষ্ট্রশক্তির হিসেব-নিকেশ একটু এদিক ওদিক হলেই তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে থাকে। যখন যেদিকে বৃষ্টি পড়ে রাষ্ট্রশক্তি তখন তার দিকে ছাতা এগিয়ে ধরে। আর রাষ্ট্র ক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে রাষ্ট্রশক্তি তখন তার দিকে ফিরেও চায় না। সেটা না হলে বিশ্বের বড় বড় সাবেক নেতারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে থাকতেন না। হিটলার নিজের মাথায় গুলি করতেন না অথবা সাদ্দাম হোসেনকে মাকড়সাল জালে আচ্ছাদিত গুহার মধ্যে থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে শত্রুসৈন্যরা ধরে নিয়ে হত্যা করতো না।

রাজনৈতিক নেতারা ক্রমাগত জেদ ও অসহিষ্ণু প্রদর্শন করতে থাকলে সাধারণ মানুষ বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। তারা নিত্যপণ্য কেনার ক্ষমতা হারিয়ে অভিশাপ দেয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদেশী প্রভুদের সহযোগিতায় তৃতীয় অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা দখল করে নেয়। এতে প্রতিহিংসার ভয় আছে, আছে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার মহাসংকট। গণমানুষ ছাড়া বিরোধীদের সাথেও কোনরূপ পারস্পরিক সংহতি, দয়ামায়া, সহানুভূতি, সমানভূতি এখনই নেই, তাই নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সেটা কোন পর্যায়ে দেখা যাবে তা বড় চিন্তার বিষয়।

তাই এখনই কোথাও না কোথাও থামতে হবে। আর বেশী নিচে নামার অবকাশ নেই। রাষ্টীয় পেশীশক্তির উপর ভর করে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান আরো দুর্বল করে ফেললে রাজনীতি অসাড় প্রতীয়মান হয়ে জনদুর্ভোগ আরো বেশী বাড়তে থাকবে। কারণ, মানবিক রাষ্ট্রে রাস্তায় জনদাবী দমনের নিমিত্তে সামাজিক বা পোলাইট নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুলি, গ্রেনেড থাকে না, থাকে শুধু একটি লাঠি। কল্যাণরাষ্ট্রে তারা রাজনীতি করেনা, তাদেরকে কেউ ব্যবহার করাতেও পারে না। আমাদের দেশে এর উল্টো পরিস্থিতি বিরাজমান। এবারের বিজয়ের মাসে শীতের কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও জ্বলন্ত রাগ-জেদ যেন পক্ষ-বিপক্ষ সবার মনের মধ্যে। প্রায় প্রতিদিন অবরোধ, মশাল মিছিল হচ্ছে, আগুন জ্বলছে, বাস পুড়ছে, ট্রেন উল্টে পড়ছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে, ঘুষের ব্যাপক লেনদেন হচ্ছে নতুবা নতুন মামলা হচ্ছে, মৃত্যু ঘটছে, জনমনে ভয় বাড়ছে।

ফলত: উভয় পক্ষের জেদে দেশের অর্থনীতি ধ্বসে যাচ্ছে, কিশোর-তরুনসমাজ নির্বাচনী রাজনীতির বহুমাত্রিক অনৈতিক চর্চ্চা অবলোকন করে চরম স্বার্থপরতা শিখছে, জাতি দিশাহীন হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন আরো নিচে নেমে যাচ্ছি। আরও কত নিচে নামলে আমাদের বোধদয় হবে?

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর