মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টলবীর

, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মদ বেলাল হোসেন | 2023-12-15 13:06:10

 

চট্টগ্রাম শহরকে যারা নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করে তাঁদের বলা হত ‘মেথর’। তারা যেখানে বাস করত সেই এলাকাকে বলা হত ‘মেথরপট্টি'। মেথর বলতে সমাজের দলিত সম্প্রদায়কে বোঝায়। যারা ছিল একধরনের অচ্যুত। যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম শহরে এই প্রথা চলে আসছে। কিন্তু সমাজের এই উচুঁ নিচু বিভাজনপ্রথা মানতে রাজি নন একজন মেয়র। তিনি চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। যিনি ‘মেথর’দের নাম পাল্টিয়ে নতুন নাম দেন ‘সেবক’। ইউনিফর্ম হিসেবে তাঁদের দেন হলুদ রঙের পোশাক, এতে লেখা হয় ‘সেবক’ শব্দটি। তাদের বসবাসের জায়গাটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘সেবক কলোনি’।

সেবকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করেন। সমাজে সাধারণ মানুষ হিসাবে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দেন। এভাবে মানবিক কর্ম দিয়ে জনমানুষের কাছে মানবতার ফেরিওয়ালা নামে পরিচিত হয়েছিলেন চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী।

সমাজে চলমান গা ভাসিয়ে দেওয়া রাজনীতির যুগে সবার টার্গেট থাকে দলের পদদখল। দলীয় পদ পেলে দলনেতা হওয়া যায়, কিন্তু জননেতা হওয়া যায় না। জননেতার প্রধান গুণ মানবিক হওয়া, মানবতার জন্য কাজ করা। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মানুষ আজও সংকট সংগ্রামে স্মরণ করে, অনুসরণ করে। তাঁরা শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গেয়েছেন মানবতার জয়গান, ধ্ববংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির কথা বলেছেন। চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁদের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং একজন পরিপূর্ণ মানবিক মানুষ। তাঁর কর্মের মধ্যে চতুরতা ছিল না, ছিল না অহমিকা, ছিল অদম্য সাহস, কর্মস্পৃহা ও দেশপ্রেম।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুরোনাম আবুল বশর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রেলওয়েতে কর্মরত থাকায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর শৈশব  কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। তিনি যখন সরকারি সিটি কলেজের ছাত্র তখনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তার মনে দাগ কাটে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে নেতৃত্ব দেন মহানগর ছাত্রলীগের। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। নেভাল বেইস টর্চার ক্যাম্পে ধারাবাহিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে বের হয়ে চলে যান ভারতে। হরিনা ইয়ুথ ক্যাম্পে পেঁৗছে দেখেন তাঁর নামেই সেখানে নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ মহিউদ্দিন ব্যারাক’। সহকমীর্রা মনে করেছিল তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন পাকসেনাদের হাতে। ভারতের উত্তর প্রদেশের তান্দুয়া কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ শেষে ‘মাউন্ট ব্যাটালিয়ন’র প্লাটুন কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন। পরে বিএলএফ এর মিডল ও সাউথ কলামের কমান্ডার নিযুক্ত হন তিনি। পার্বত্য এলাকায় তিনশো মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা হিসাবে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিজয়ীর বেশে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী দেখতে সুদর্শন ছিলেন না। বক্তৃতার সময় কথার ব্যাকরণ ঠিক থাকত না। যা দিত একদম কাটখোট্টা। প্রয়োজনে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রধানতম নেতা হয়ে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। কালুরঘাটে গার্মেন্টসের আগুনে পুড়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, বন্দরটিলায় নৌবাহিনীর সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ সবকিছুতেই সর্বাগ্রে ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূল জুড়ে ছিল লাশের স্তূপ, সেই লাশ দাফন ও অসহায় মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে মুসলিম ইনস্টিটিউটে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলেন তিনি। এককথায় যখনি চট্টগ্রামের দুর্দিন সেখানে হাজির হয়েছেন বীর মহিউদ্দিন।

তিনি শুধু মৃত লাশের সৎকার করেননি, অনুধাবন করেছেন লাশ পরিবহনে শহরবাসীর বিড়ম্বনার কথা। তাই ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন—এর উদ্যোগে লাশ পরিবহনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ব্যবস্থা করেন। হজব্রত পালনের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে গড়ে তুলেছিলেন মেয়র হজ কাফেলা। তিনি কত বড় মানবিক মানুষ তা শোনা যায় হাজীদের মুখ থেকে। আরাফাতের রৌদ্রতপ্ততায় অস্থির হয়ে তিনি হাজিদের জন্য নিজে ড্রামে করে শরবত বানাতেন। অসুস্থ হাজিদের মলমূত্র পরিস্কার, দুর্গন্ধযুক্ত পোশাক ধৌত করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। মননে, চিন্তায় ও কর্মে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শের মূর্তপ্রতীক। যেমন মুসলিমদের মসজিদ নিয়ে ভেবেছেন, তেমনি হিন্দুদের শ্মশান নিয়ে ভেবেছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সৎকারে তিনি অভয়মিত্র মহাশ্মশান এবং বৌদ্ধদের সৎকারে কালুরঘাটে স্থাপন করেছেন গ্যাসচুল্লি। হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য তীর্থ ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। তাঁর কাছে মানবতাই ছিল পরমধর্ম।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একটানা ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করেছেন। আপন হাতে ঢেলে সাজিয়েছেন  নগরের অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। নতুন আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে গড়ে তুলেন মাতৃসদন হাসপাতাল ও আরবান হেলথ ক্লিনিক। পৌর চেয়ারম্যান নুর আহমদ চট্টগ্রাম শহরে শিক্ষাব্যবস্থার যে অগ্রগতির সূচনা করেন, তাতে নতুন গতি সঞ্চার করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়নে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে পদক্ষেপ নেন। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হেলথ টেকনোলজি সেন্টার। উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ জনমানুষের শক্তিশালী প্লাটফর্ম গড়ে তোলেন।        

চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্নে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন আপষহীন। আমেরিকার এসএসএ কোম্পানি ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের মোহনায় পোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিলে মহিউদ্দিন চৌধুরী তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে তা বন্ধ করে দেন। একইভাবে বছরে মাত্র ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে শাহ আমানত বিমানবন্দর থাই কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে গর্জে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এখন রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠান বছরে শতকোটি টাকার বেশি আয় করে প্রমাণ করেছে যে, সিদ্ধান্তটি ছিল হঠকারী। তিনি ভাবতেন চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বন্দর, কর্ণফুলী নদীসহ বৃহৎ চট্টগ্রামের অমূল্য সম্পদ ভাণ্ডার নিয়ে। মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলন করেছিলেন কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণের জন্য। আজ কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মিত হয়েছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বপ্ন আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। চট্টগ্রামের উন্নয়ন অগ্রগতি সংকটে সংগ্রামে একাকার ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

সমাজ ও রাজনীতিতে সবাই নেতা বা নায়কের স্থান করে নিতে পারে না। ইতিহাসে নায়ক হওয়ার মতো মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস আপন তাগিদে নায়কের উদ্ভব ঘটায়। চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তেমনি এক অবিসংবাদিত নেতা, যার সৃষ্টি ইতিহাসের প্রয়োজনে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের একনিষ্ঠ কমীর্ মহিউদ্দিন চৌধুরী। আজ থেকে হাজার বছর পরে যখনি চট্টগ্রামের উন্নতি ও সমৃদ্ধির ইতিহাস লেখা হবে, তখনি লেখক ও গবেষকদের ফুটনোটে বারবার ফিরে ফিরে আসবে মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী নামটি।

লেখক: ইতিহাস বিষয়ক গবেষক ও প্রাবন্ধিক, historybelal30@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর