জাতিগত পরিচয় ‘আমরা বাঙালি’

, যুক্তিতর্ক

শরিফুল হাসান সুমন | 2023-12-13 13:28:19

 

“আমরা হিন্দু-মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য যে আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা-প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালির এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে এবং টুপি-লুঙ্গিতে দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই— ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ”

মানব সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে মানুষ সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করে। দিনে দিনে সংখ্যায় যখন তারা বাড়তে থাকে তখন নতুন বসতি বা খাদ্যের প্রয়োজনে সেই স্থান থেকে মানুষ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে। নতুন ভৌগলিক অবস্থানে গিয়ে সেখানের পরিবেশ, যা খাবার পাওয়া যায় সেই অনুযায়ী আলাদাভাবে বেড়ে উঠতে থাকে মানুষ। ছেড়ে আসা পূর্বপুরুষের শেখানো কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রীতিনীতির সাথে পরিবেশগত কারণে নিজেদের শেখা কিছু নিয়মকানুন মিলে মিশে শতেক বছরে একটা সামষ্টিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়ে সেই জনপদে। সাথে যোগ হয় নৃ-তত্ত্বের কারণে সৃষ্ট শারীরিক বিবর্তন যেমন গায়ের রঙ, চুলের রঙ, চুলের ধরন, দেহের আকার, পোশাকাদি। বিবর্তিত এই সকল বৈশিষ্ট্য মিলে মিশে সৃষ্টি হয় এক নতুন জাতিসত্তার।

আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে ভিন্ন ভিন্ন হয় জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য। আরবের মরু অঞ্চলে যে জাতিসত্ত্বার উদ্ভব হয়েছিল সেটা সেখানকার মরুভূমি, প্রচণ্ড গরম, পানিহীনতা, গাছগাছালির অভাবের কারণে একটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত হয়েছে। খেজুর গাছ, আর প্রধান খাদ্য খেজুর, খেজুরের পাতার আচ্ছাদনে তৈরি ঘর, পানির কুপ, লু হাওয়া আর তাপ থেকে বাচতে লম্বা জোব্বা পোশাক, হিজাবের মতো আচ্ছাদন, শুকনো রুটি, দুম্বা আর উটের শুকনা মাংসের খাদ্যাভ্যাস সবই সৃষ্টি হয়েছে; যুগযুগ ধরে সেখানে বসবাস করা আরব বেদুইনদের অভ্যস্ততায়। তারা তাদের বৈশিষ্ট্যে অদ্বিতীয়। আফ্রিকা বা ইউরোপের মরুভূমি এলাকায় বসবাস করা মানুষের জীবন ধারণের বৈশিষ্ট্যের সাথে আরব অঞ্চলের মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। টিকে থাকার হাতিয়ার থেকে শুরু করে বাহনও আলাদা। আলাদা আলাদা জীবনযাপনপ্রণালী, খাদ্যাভ্যাস। একই ভূ-বৈশিষ্ট্য অঞ্চলের মানুষ হওয়ার পরেও কোন অবস্থাতেই মিডলইস্ট, ইউরোপ আর আফ্রিকার মরু অঞ্চলের মানুষের জাতিগত বৈশিষ্ট্য এক না।

বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব

মূলত নদীবাহিত পলি দিয়ে সৃষ্ট এই বঙ্গে জনপদের বসবাস শুরু হয় ষষ্ঠ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে যখন এই অঞ্চল ছিল মগদ রাজ্যের অংশ। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দেও গ্রিক বীর আলেকজান্ডার এই বঙ্গে এসে বাংলার বিশাল বাহিনী দেখে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যান। গ্রিক লেখকদের প্রাচীনলিপিতে “গঙ্গারিডাই” নামে এক শক্তিশালী জাতির উল্লেখ আছে। এটাই বাঙলা জনপদের প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরানো ইতিহাস। খ্রিষ্ট পরবর্তী ষষ্ঠ  শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পরে বাংলায় দুটি স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়, বঙ্গ ও গৌড়। আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় যে জনপদের হদিস এই অঞ্চলে পাওয়া যায় তার নাম “বঙ্গ”, যাদের মূল আবাসস্থল ছিল ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও ফরিদপুরের তথা বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চল জুড়ে। এই বঙ্গ থেকেই বাঙালি জাতির উদ্ভবের সবচেয়ে প্রাচীন ইতিহাস পাওয়া যায়। এছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আর কিছু জনপদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্বের প্রারম্ভিক যুগে, যেমন গৌড় (চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আর ভারতে মুর্শিদাবাদ মালদাহ, বর্ধমান, নদিয়া অঞ্চল), পুণ্ড্র (বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর), হারিকেল (সিলেট চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম), সমতট (বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ত্রিপুরা), বরেন্দ্র (পুণ্ড্র জনপদের সাথে বগুড়া দিনাজপুর, রাজশাহী পাবনা জুরে এদের অবস্থান ছিল) এবং চন্দ্রদ্বীপ জনপদের অবস্থান ছিল বরিশাল অঞ্চলে।

চাষাবাদের জন্য উর্বর দোআঁশ মাটির ভূমি আর চারিদিকে নদীবেষ্টিত থাকায় পশু পাখি আর মাছের সহজ প্রাপ্যতার কারণে এখানে জনপদ বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। কৃষক, পশুপালক, জেলেদের সাথে সৃষ্টি হয় মাটির তৈজসপত্র বানানো কুমোর ও দা, কুড়াল, লাঙল, কোদাল বানানো কামারের উপযোগিতা। মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী, কামার কুমোরের জনপদে যুক্ত হয় বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশিক্ষিত সৈনিকদের সংমিশ্রণ, আসে ব্যবসায়ীরা। আর সময়ের পরিক্রমায় প্রকৃতিগতভাবে প্রতিকূলের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা, জীবন সংগ্রাম করে টিকে থাকা একরোখা, শারীরিকভাবে পরিশ্রমী, শক্তিশালী এক জাতিসত্তার সৃষ্টি হয় এই ভূখণ্ডে। যারা সারাবছর যেমন গৃহস্থালি আর পশুপালন করে খাদ্যের যোগান দিতে পারে, আবার চর দখলে লাঠি বর্শা হাতে বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ভূমিপুত্রদের শারীরিক ভাবে শক্ত গঠন, রোদে পোড় খাওয়া পরিশ্রমী এই জনপদ অস্তিত্বের সংগ্রামে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে লড়তে শিখেছে সংঘবদ্ধ ভাবে। সাহায্য সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহানুভূতিশীল, নরম হৃদয়ের অধিকারী হতে শিখেছে পরিবেশগত কারণেই। আর নিজেদের মতো করেই আনন্দ খুঁজে নিতে শিখেছে বিভিন্ন উৎসব সৃষ্টির মাধ্যমে। যেই সংস্কৃতি আর উৎসবের চল ছিল এই অঞ্চলে, তা আর কোন অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতি আমাদের ভু-বৈশিষ্ট্য আর পরিবেশের কারণে সৃষ্টি।

বাঙালির সংস্কৃতি

গ্রামে নতুন ফসল উঠলে নবান্ন উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, বসন্তবরণ, হালখাতা, নববর্ষ, নববর্ষ উপলক্ষে মেলা, পিঠেপুলির মেলা, পুতুল নাচ, মোরগ লড়াই, পথনাটক, মঞ্চনাটক, লোকগীতি, ভাটিয়ালি গান, বাউল সভা, যাত্রাপালা, পালা গান, জারিগান, সারি গান, পুথি পাঠ, কবিসভা, সাহিত্য সভা, পাঠচক্র এগুলো সবই ভূ বৈশিষ্ট্য আর পরিবেশগত কারণ, জীবনযাপনপ্রণালি থেকেই সৃষ্টি। বাঙালি থেকে এই সংস্কৃতি আলাদা করা সম্ভব নয়। বরং এই সংস্কৃতির কারণেই আমরা বাঙালি।

ভৌগলিক অবস্থার কারণে যদি আমরা এশিয়ান হই, উত্তরাধিকার সূত্রে যদি আমরা ভারতীয় হই, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ আর সার্বভৌমত্ব সূত্রে আমরা বাঙালি হিসাবে আলাদা একটা পরিচয় সৃষ্টি করতে পেরেছি। এটাই আমাদের জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

যতদিন আরবরা নিজেদের জাতিসত্তাকে চিনতে বুঝতে পারেনি ততদিন তারা ভিন্ন ভিন্ন গোত্রে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করেছে। খণ্ড খণ্ড গোত্রে তারা একে অপরের সাথে একটা পানির কুপের দখল নিয়ে, বা খেজুর বাগানের দখল নিয়ে বা বিবাহযোগ্য নারীর দখল নিয়ে লড়াই করছে। শুধু আরবরা নয়, নিজ নিজ জাতিসত্তাকে অনুধাবন করতে না পেরে, নিজ নিজ জাতীয়তাবাদকে ধারণ করতে না পেরে বাইজেন্টাইন থেকে শুরু করে রোমান এবং ইংলিশ জাতিরাও পরস্পরের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই লড়াইয়ে প্রতিটা জাতিই হারিয়েছে সমৃদ্ধি, সাম্রাজ্য, আর হারিয়েছে মানুষ, অজস্র তাজা প্রাণ।

বিচ্ছিন্নতা আর সব হারানোর শতাব্দীর ইতিহাসের পরে প্রতিটা জাতিতে কোন না কোন নেতৃত্বের আবির্ভাব হয়েছিল, যারা নিজ নিজ জাতিকে, স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে একত্রিত করতে পেরেছিল। আর একত্রিত হতে পারাই ছিল সমৃদ্ধি আর জ্ঞানার্জন করে উন্নত জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার পথরেখা। বাইজেন্টাইনদের এমন অনেক নেতৃত্ব যেমন এসেছিল, তেমনি এসেছিল রোমানদেরও, যারা নিজ নিজ জাতীয়তাবাদকে উচ্চে তুলে ধরে সমৃদ্ধি আর জ্ঞানার্জনের পথকে উন্মুক্ত করেছিল। বাইজেন্টাইনদের জাস্টিনেইন আর রোমানদের মধ্যে জুলিয়াস সিজার হয়তো সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে এই তালিকায়। তেমনি আরবদেরও জাতীয়তাবাদের ধারক বিভিন্ন গোত্র আর সম্প্রদায়কে একত্রিত করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ। উনি একাধারে যেমন আল্লাহ প্রেরিত পথপ্রদর্শক ছিলেন, তেমনি ছিলেন আরব সাম্রাজ্যকে একত্রীভূত করার মতো একজন উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব।  জাতিসত্তাকে নেতৃত্ব দিয়ে উন্নতি আর সমৃদ্ধির পথ দেখানো সকল নেতৃত্বই তো আর সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত ছিলেন না, হযরত মোহাম্মদ এখানে ব্যতিক্রম শুধু। এছাড়া আর সবাই ছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা অসাধারণ সব পথ প্রদর্শনকারী।

জাতিসত্তার মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য একটা জনপদকে ঐক্যবদ্ধ করে, তার বাইরেও আরও কিছু বৈশিষ্ট্য চাপিয়ে দেয়া কখনও সুখকর কিছু বয়ে আনে না। যেমন ধর্মকে জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য হিসাবে ধারণ করে আরব আজকে শতভাগে বিভক্ত, সবাই সবার শত্রু। রোমানরাও সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি ধর্মকে আর চার্চকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। একই অবস্থা আফ্রিকার ক্ষেত্রেও, ধর্ম, ক্ষমতা আর রাজনীতি শত খণ্ড করেছে তাদের।

সংস্কৃতি, আকার আকৃতি, রঙ, খাদ্যাভাস, পোশাক, জীবনাচার, এইসকল মৌলিক বৈশিষ্ট্যের বাইরে আমরাও কি কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি আমাদের পরিচয়ের উপর? কোন আচকান, কোন, টুপি, লেবাস, ধার করা বা ভিন্ন সংস্কৃতি? তাহলে ইতিহাস সাক্ষী, আমাদেরও ভাঙন অবশ্যম্ভাবী।

বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। উনি প্রতিটা অঞ্চলে গিয়েছেন, মিশেছেন প্রতিটা মানুষের সাথে। উনি দেখেছেন, অনুধাবন করেছেন বাঙালি ভূমিপুত্রদের। উনি এই জনপদে একটি ব্যতিক্রমী মৌলিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে আবেগ, অনুভূতি।  বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেছিলেনও: “‘জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণপণ সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূল নীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, অনেক মনিষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেকরকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং এ সম্পর্কে আমি নতুন কোনো সংজ্ঞা আর নাই বা দিলাম। আমি শুধু বলতে পারি, আমি যে বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি। এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিস রয়েছে সেটি হচ্ছে অনুভূতি। সেই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না। অনেক জাতি আছে যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক জাতি হয়েছে (আমার উদাহরণ: ভারত)। অনেক দেশে আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সব কিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতি হতে পারে নাই (আমার উদাহরণ: লিবিয়া, সোমালিয়াসহ আফ্রিকার কিছু দেশ যারা ধর্ম-ভাষায় এক হয়েও ট্রাইবের ভিত্তিতে বিভক্ত)। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে, এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতিটুকু আছে বলেই আমি বাঙালি, আমার জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ।’

আদতে এটাই আমাদের একমাত্র পরিচয়, আমরা আবেগী বাঙালি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর