নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ভূয়া ভিডিও ছড়ানো ব্যক্তিরা কেন ছাড় পাচ্ছে

, যুক্তিতর্ক

আসাদুল হক খোকন | 2023-12-06 18:22:08

বেশ কিছুদিন ধরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কক্ষের কয়েকটি ভিডিও বিশেষ করে- হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক, টিলিং টিলিং সাইকেল চলাই, ব্যাঙ লাফসহ ছড়ায় ছড়ায় নাচের বেশকিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। নিজেদের পেজে শেয়ার দিয়ে এসব ভিডিও নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ বলে জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ কেউ কেউ নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের রীতিমত বিষোদগার করছেন। এমনকি নতুন শিক্ষাক্রমকে দেশ ও জাতি বিরোধী বলে মন্তব্য করে বৃহৎ আন্দোলনের হুমকিও দিচ্ছেন কেউ কেউ।

গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে তোলপাড় হলেও বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবশেষে গত রোববার বিষয়টি পরিস্কার করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে আইটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু এসব ভিডিও নতুন শিক্ষাক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ছড়ানো হচ্ছে তাই ভিডিওগুলো ভাইরাল হবার আগে বা সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে তা নিয়ে দেশের মানুষকে জানানো উচিত ছিল। একই সঙ্গে উচিত ছিল- এসব ভিডিও ছড়ানো ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা। তাহলে পরবর্তীতে এমন ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনার হার কমে যেত।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এনসিটিবির এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে বলা হয়, এই শিক্ষাক্রমের কোথাও নবীর ছবি আঁকতে বলা হয়নি। স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী অপচেষ্টার অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কাজকে শিক্ষাক্রমের কাজ বলে প্রচার করছে।

এনটিসি জানিয়েছে, হিন্দি গানের সঙ্গে স্কুলের পোশাক পরা কিছু ছেলেমেয়ে ও ব্যক্তির অশ্লীল নাচ আপলোড করে বলা হচ্ছে শিক্ষক্রমের নির্দেশনা, যা সব মিথ্যা। কিছু লোক ব্যাঙের লাফ বা হাঁসের ডাক দিচ্ছে, এমন ভিডিও আপলোড করে বলা হচ্ছে এটা নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষক প্রশিক্ষণের অংশ, যা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। নতুন শিক্ষাক্রমে সব ধর্ম বর্ণের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে।

এনটিসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে বিকশিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যারা এমন মিথ্যাচার করছেন তাদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করা হয়। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানান তারা। একই সঙ্গে এসব মিথ্যাচারে সর্বসাধারণকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

এনটিসির এই বিজ্ঞপ্তির পর নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যে পুনরায় নতুন আঙ্গিকে জল ঘোলা করা হবে না, ষড়যন্ত্র করা হবে না তা হলপ করে বলা যায় না। এর কারণ খুঁজতে হলে ঘটনার একটু গভীরে যেতে হবে। দেশ বিদেশে অসংখ্য আলোচিত, সময়োপযোগি ঘটনা বিশেষ করে দেশে নির্বাচনের মতো গরম খবর থাকলেও হঠাৎ নতুন শিক্ষাক্রমকেই কেন টারগেটে পরিণত করা হলো? কেন খুঁজে খুঁজে শিশুতোষ নাচানাচিসহ হাস্যরসাত্মক ভিডিওকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করা হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

যদিও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে আমি ভিডিওগুলো নিয়ে ফ্যাক্ট চেক শুরু করেছিলাম গত সপ্তাহে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি পরিস্কার করবেন বলে বিশেষ সূত্রে জানতে পেরে ফ্যাক্ট চেক স্থগিত করি। কয়েকদিন অপেক্ষা করে ফ্যাক্ট চেক করি এবং এর মধ্যেই এনটিসির বক্তব্যও পেয়ে যাই।

এর মধ্যে ‘টিলিং টিলিং সাইকেল চলাই’ ভিডিওটির ফ্যাক্ট চেক করে পাওয়া গেছে- নতুন শিক্ষাক্রম তো দূরের কথা এটি আমাদের দেশের কোনো ভিডিও নয়। ভারতের আসামের রতন লাল সাহা নামের একজন প্রশিক্ষকের পেজে এই ভিডিওটি আপলোড করেন ২০২২ সালে। এ সম্পর্কে রতন লাল তার এক পোস্টে লেখেন- ‘টিলিং টিলিং সাইক্লিং যা 2022 সালে আসামে ভাইরাল হয়ছিল। এবার বাংলাদেশও ভাইরাল।’

একই দিন তিনি আরও একটি পোস্টে লেখেন- আসাম সরকারি স্কুল, ক্লাস-১, লেসন-৪, (হাট বাজার চল)...। অর্থাৎ এটি যে আসামের সরকারি স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম তা তার এ পোস্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়। রতন লাল মূলত একজন এফএলএন ট্রেইনার। মজা বা আনন্দের মধ্য দিয়ে, অভিনয়, ছড়া প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষাক্রমকে সহজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য রতন লাল আসামে জনপ্রিয়। এছাড়া অন্য ভিডিওগুলোও আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমের নয় যা ইতিমধ্যে এনটিসি পরিস্কার করেছেন।

এখন প্রশ্ন হলো- ভারতের এই ভিডিও তুলে এনে বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলো কেন? কেন এসব ভিডিও আপলোড করে দেশের জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তোলা হলো? এর উদ্দেশ্যই বা কি? এসবের বেশ কয়েকটি উত্তর হতে পারে। এর মধ্যে দুটি উত্তর নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। প্রথম- নতুন শিক্ষাক্রম নয়, ভেতরে ভেতরে কৌশলে সরকারের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠীকে দাঁড় করিয়ে দেয়া। দ্বিতীয়ত- নতুন এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা।

ভূয়া ভিডিও ছড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ দাঁড় করানো এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে এর বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরোক্ষভাবে যারা লাভবান হতে চাইছেন তারা নিশ্চয় দেশের মঙ্গল কামনা করছেন না। কারণ যাই হোক, যে বা যারা এই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, পেছনের কলকাঠি নাড়ছেন, তাদের বিরুদ্ধে সরকার বা সংশ্লিষ্ঠ মহল কি যথেষ্ট সচেতন? এমন অভিনব মিথ্যা ভিডিও উপস্থাপন করে যে মিথ্যাকে সত্য হিসেবে তারা দেশের জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তাদের বিরুদ্ধে কি এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল না?

যেখানে এনটিসি প্রমাণ পেলো যে, ‘স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী অপচেষ্টার অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কাজকে শিক্ষাক্রমের কাজ বলে প্রচার করছে।’সেখানে এই প্রমাণিত মিথ্যা, অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছে এনটিসি?

যে কেউ অপরাধ করলে তার বিচার হয়, অপরাধ প্রমাণিত হলে তার জন্য যথাপযুক্ত শাস্তি পেতে হয়- এই নজির বা দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হলে এমন অপরাধ, মারাত্মক অপপ্রচার বারবার যে ঘটবে তাতে সন্দেহ নেই। উপরন্তু, এসব অপরাধীর অনেকেই ‘বিচার বা শাস্তির আওতায়’ আসেনি বলে এহেন কার্যকলাপে বরং উৎসাহিত বোধ করবে। এসব অপরাধী ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়ায় বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে তারা পুনরায় নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের ফাঁদ তৈরি করে পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্ত মনে হাওয়ায় দোল খাবে। সুতরাং- সাধু সাবধান!

লেখক: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর