কিসিঞ্জার পাঠ ও মূল্যায়ন যথার্থ হচ্ছে কি?

, যুক্তিতর্ক

কাজল রশীদ শাহীন | 2023-12-04 18:02:32

 

হেনরি কিসিঞ্জার, শতায়ু পেরিয়ে ইহলোককে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। একশ বছরের পার্থিব জীবনের পঞ্চাশ বছরই তিনি আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী তিনি। অধ্যাপক, গবেষকের অভিজ্ঞতা থাকলেও একজন কূটনীতিক হিসেবে তিনি কেবল মার্কিন মূলুকে নয়, বিশ্বব্যাপী রেখেছেন নানামুখী অবদান। যা ক্ষেত্রবিশেষে ভয়ংকর রকমের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি ও সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়য়েছে।

বাংলাদেশের মানুষেরা এই ব্যক্তিটিকে অন্যরকমভাবে চেনেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনার ভূমিকার প্রশ্নে এবং ‘বটমলেস বাস্কেট’ উক্তির কারণে। সেই থেকে মৃত্যুাবধি-এমনকি মৃ্ত্যুর পরও উনার প্রতি প্রচ্ছন্ন নয় প্রকাশ্য বিরাগও প্রদর্শিত করেন বহু মানুষ। ব্যাপারটা দুই-দশজনের মধ্যে কিংবা বিশেষ কোন বর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে-ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের ব্যতিক্রম বাদে সকলেই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত।  কারণ সেটা মিথ, কিংবদন্তি বা বাগধারার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখানে কেউ যদি বেশি চালাকি করে। বুদ্ধি খাটিয়ে কাউকে ধোঁকা দেয়। কৌশলে কোন মুস্কিলের আসান করে তাহলে এদেরকে একবাক্যে ‘কিসিঞ্জার’ বলে। এই এই ধরনের বুদ্ধিকে, ‘কিসিঞ্জারি বুদ্ধি’ বা ‘কিসিঞ্জারি প্যাঁচ’ জ্ঞান করা হয়। ব্যাপারটার মধ্যে ঠাট্টা, বিদ্রুপ বা রসিকতা হয়তো রয়েছে। কিন্তু বিষয়টাকে হালকাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। নেয়াটা যৌক্তিকও নয়।

এদেশের মানুষেরা কিসিঞ্জারি বুদ্ধিকে দু’রকমভাবে দেখে- এক. বুদ্ধি খাটিয়েও সফল না হওয়া বা, বেশি চালাকি করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া। দুই. অনেক চেষ্টা তদবির করে সফল না হওয়ায় হেয় করা বা বাজে ও অযৌক্তিক মন্তব্য করা। এখন আসা যাক, প্রথম প্রসঙ্গ। কেনো কিসিঞ্জারি বুদ্ধিকে এভাবে দেখা হয়। এর কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিসিঞ্জারের হিংসাত্মক মনোভাব ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যেন জয়ী হতে না পারে তার জন্য কিসিঞ্জার এমন কোন চেষ্টা বা পদক্ষেপ নেই তিনি করেননি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতায় ভারতকে বিরত রাখতে কিসিঞ্জার আগ্রাসী কূটনীতির আশ্রয় নেয়। উনার কারণেই মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও ক্ষমতাসীন প্রশাসন বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও তাদের পক্ষে নেয়ার কূটনীতি শুরু করে। এই কূটনীতির স্রষ্টা হল হেনরি কিসিঞ্জার। যার অংশ হিসেবে তিনি চীনকেও তাদের পক্ষে নেয়। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ককে আর বেশি গাঢ় করে তোলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নানাভাবে নিজেদের মতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনভাবেই যখন উনাকে পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব না হওয়ায় কিসিঞ্জার অভ্যাসবশত ইন্দিরাকে নিয়ে বাজে মন্তব্যও করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন যে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, যা বঙ্গোপসাগর অবধি এসেও ছিল। কিসিঞ্জারের কূটনীতির কারণেই এসব হয়েছিল।

যতভাবে ও যতপ্রকারে সম্ভব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের দাবিকে পরাভূত ও পরাজিত করতে যা যা করণীয়, তার সবটাই করেছিল মার্কিন প্রশাসন-যার কূটনৈতিক মন্ত্রদাতা ছিলেন কিসিঞ্জার। কিন্তু কোন চেষ্টায় সফল হয় বাঙালির লড়াকু মনোভাব ও ভারত-রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আমাদের পাশে থাকার জন্য। এতে এটাও প্রমাণিত হয়েছিল যে, যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন এবং ষড়যন্ত্রকারী যতই শক্তিধর হোক না কেন, ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্যতাভিত্তিক কোন দাবিকেই ‘দাবায়ে’ রাখা যায় না। এ কারণেই বাংলাদেশের মানুষ আজও কেউ যখন অন্যায়ভাবে কিছু করে, তাকে কিসিঞ্জার বলে এবং এধরণের বুদ্ধিধরদের কিসিঞ্জারি বুদ্ধি বলে চিহ্নিত করে।

কিসিঞ্জারের মৃত্যুর পর যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশে এবং বিদেশে। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের দেশের গুণীজনরা যেমন রয়েছেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্নরাও উপস্থিত আছেন। গার্ডিয়ান, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের মতো আন্তর্জাতিক প্রভাবশারী দৈনিকের লেখাও এই বিবেচনার মধ্যে পড়ে। সবগুলো লেখারই মৌল স্বর এক ও অভিন্ন। প্রশ্ন হল, কিসিঞ্জারের সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা কি উনার বুদ্ধিমত্তা ও কূটনীতিক ক্ষমতার কথা ভুলে গেছি? কূটনীতি দিয়ে তিনি ক্ষেত্র বিশেষে কিছু জায়গায় কিংবা বেশীরভাগ জায়গায় শঠতার পরিচিয় দিয়েছেন । যা অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উনার বিচারের দাবি উঠেছে। কিন্তু কিসিঞ্জারের কুটনীতির পাল্টা পাঠ মেলেনি। কূটনৈতিক কিসিঞ্জারকে কূটনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা দেখা যায়নি।

এ লেখায় আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কিসিঞ্জার নামটা শুনলেই বা উচ্চারিত হওয়া মাত্র বহুল উচ্চারিত সেই বাক্যটাই সামনেই আসে, ‘বটমলেস বাস্কেট’। কোন প্রেক্ষাপটে কী বিবেচনায় তিনি এ কথা বলেছিলেন তা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেলের বাস্তবতাকে ঘিরে তিনি ওকথা বলেছিলেন। হ্যাঁ, ওই কথার মধ্যে-বিদ্রুপ, শ্লেষ, অবমাননা সবই ছিল। যা মেনে নেয়া বা সহ্য করা কোন দেশপ্রেমিকের পক্ষেই সম্ভব নয়।

কিসিঞ্জার যা সেদিন বলেছিল, আজ তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রমাণ করে দেখিয়েছে সে বটমলেস বাস্কেট নয়। এখন এই প্রসঙ্গ আমরা যদি একটু উদারভাবে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে কোন্ সত্যে আমরা হাজির হব। সত্যিই কি সেদিনের বাংলাদেশ বটমলেস বাস্কেট ছিল না? যদি তাই-ই না হবে তাহলে আজকের অবস্থানে আসতে আমাদের এত সময় কেন লাগলো? আবার এই প্রশ্ন ওঠা কি সঙ্গত নয়, পঞ্চাশ বছরে একটা স্বাধীন দেশের যে অবস্থায় যাওয়ার কথা ছিল সেখানে কি পৌঁছানো সম্ভব হল? গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তায়, বাক্ স্বাধীনতার চর্চায়, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রশ্নে, নীতি ও ন্যায্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকারে আমরা কি আদৌ কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারলাম?

আমরা সকলেই জানি, আমেরিকা-চীনের সম্পর্ক মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বৈরিতায় ভরা। তারপরও কিসিঞ্জার নিজস্ব কূটনীতি দিয়ে সেই সম্পর্ক এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন যা, দুইদেশের কাছে প্রশংসনীয়। চীনের কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে আমেরিকান তিনি হলেন কিসিঞ্জার। উনার শতবর্ষের জয়ন্তী যখন আমেরিকায় উদযাপিত হয়, তখন চীনেও তার ছোঁয়া লাগে। চীনারাও নিজেদের মধ্যে আয়োজন করেন একজন আমেরিকানের জন্মদিন। যখন ‍দুটো দেশ একে অপরের প্রতি উষ্মা প্রকাশে সিদ্ধ ও রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তখন এ ধরনের আয়োজন বিস্ময়ের শুধু নয়, একজন কূটনীতিকের সুদূরপ্রসারী সাফল্যেরও অংশ।

নোবেল কমিটি কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল দিয়েছেন। বলা হয়, নোবেলের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত পুরস্কার ছিল এটি। কমিটির দু’জন সদস্য প্রতিবাদে পদত্যাগও করেন। ভিয়েতনাম-মার্কিন যুদ্ধ অবসানে পদক্ষেপ নেয়ায় তিনি নোবেল পান ১৯৭৩ সালে। এরপর আরও দু’বছর লেগে যায় যুদ্ধ নিরসনে। প্রশ্ন হল, কিসিঞ্জারের ওই উদ্যোগ কি ভুল ছিল। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ের কোন মার্কিন রাষ্টপতিকে নোবেল না দিয়ে কেন উনাকে দেয়া হল? উনি কি সত্যিই কোন পদক্ষেপ রাখেননি যুদ্ধ বন্ধে? এসব পশ্নের যৌক্তিক উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।

বলা হয়, কিসিঞ্জারের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ বেধেছে। আবার একথাও সত্য যে, তিনি কোনো কোনো যুদ্ধ বন্ধেও সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কিসিঞ্জারের যত দোষ-ত্রুটি ধরা হয়, একজন আমেরিকানের কাছে কিন্তু তিনি এসবের ঊর্ধ্বে। সকল মার্কিনীদের কাছে তিনি বন্দিত। উনার কূটনীতির তারিফ করেন সবাই, তা তিনি ডেমোক্রেট হোক অথব রিপাবলিক। এখানেই কিসিঞ্জারকে বিবেচনায় নিয়ে সমালোচনা করা উচিৎ। তিনি হয়তো আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু দেশপ্রেমিক হিসেবে, একজন আমেরিকান হিসেবে কি অনন্য নন?

কিসিঞ্জারের সমালোচনা যতটা করা হয়, বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করা হয়, সেভাবে উনার কূটনীতির প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বি কিন্তু সেভাবে দেখা যায় না, নেই বললেই চলে। সমালোচনা করা সহজ। প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বি হওয়া কঠিন। কিসিঞ্জার প্রশ্নে আমরা কি সহজ পথটাই বেছে নেয়নি? আমেরিকার মোকাবেলা যেমন আমেরিকার মতো হয়েই করতে হবে, তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা জারি রাখতে হবে। তেমনি কিসিঞ্জারের যা কিছু অপছন্দ, যা কিছু ঘৃণা ও বিবমিষার তার মোকাবেলা করতে হবে প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে-তাকে ছাড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে। কেবল বিদ্রুপ, সমালোচনা আর কটুকথা দিয়ে কোন অর্জন হয় না, বরং আরও শক্তিধর করে তোলা হয়। কিসিঞ্জারের মূল্যায়নে-কিসিঞ্জারে পাঠে আমরা কোনটা করছি, সেটা কি একবার ভেবে দেখছি?

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

kazal123rashid@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর