ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা

, যুক্তিতর্ক

শরিফুল হাসান সুমন | 2023-12-02 19:54:25

গত ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনের বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠির বিষয় ছিল—‘বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি’ বিষয়ে সংকলিত প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রতিবেদন যদিও সারাবিশ্বের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, তারপরেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এই স্মারকলিপির লক্ষ্য হতে পারে। বাংলাদেশের শ্রম ইস্যু (গার্মেন্টস কর্মীর মৃত্যু) উল্লেখ করেছেন সেক্রেটারি অব স্টেটস উনার স্মারকলিপি প্রকাশ অনুষ্ঠানের বক্তব্যে। এই নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম ইস্যুতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজস্ব কূটনীতিক বা মিশন প্রধানেরা যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের উপর এই নীতি আরোপ হতে পারে, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার হরণ হচ্ছে।

এই নীতির অনেক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে যা বিপদ সংকেত এর কারণ হতে পারে। এই নীতির পেছনের কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অভিলাষ, এবং যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে এটার ব্যবহার করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের জন্য একটা সতর্কবার্তা যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার ইস্যুতে কী কী করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এবং এটি অবশ্যই বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় রাখা উচিত।

এই ছিল ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রেরিত চিঠির সারসংক্ষেপ। গত ১৬ নভেম্বর সান ফ্রান্সিসকোতে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশনের (এপিইসি) একটি আয়োজনে ওই স্মারকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। শ্রম অধিকার হরণ করে এমন কার্যক্রমের জন্য বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত শ্রমনীতির প্রেক্ষিতে প্রতিটা দেশের রাষ্ট্রদূতই সম্ভবত নিজ নিজ দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এমন সতর্কবার্তা পাঠিয়ে থাকে।

কী ছিল মার্কিন প্রশাসনের ঘোষিত শ্রমনীতিতে?
১. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান রক্ষা ও প্রচারের জন্য আমরা সারা বিশ্বে সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতকে যুক্ত করব। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সমস্ত রাষ্ট্রদূত, সমস্ত লোক যারা বিশ্বজুড়ে আমাদের দূতাবাস চালাচ্ছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে, ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকবেন যাতে তাদের কণ্ঠস্বর আমরা যা কিছু করি তাতে প্রতিফলিত হয়।

২. যারা হুমকি দেয়, যারা ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রম অধিকার রক্ষাকারী, শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে—নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য জরিমানা, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো জিনিস ব্যবহার করে, আমাদের এখতিয়ারের সবকিছু প্রয়োগ করে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য করব।

৩. আমরা শ্রম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মচারীদের জন্য বৃহত্তর কাজের সুযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে জানার জন্য, অপব্যবহার খোঁজা এবং প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে কর্মীদের অধিকারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ফেডারেল সরকারের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করব।

৪. আমরা শ্রম অধিকার এবং মান উন্নীত করার জন্য সরকার এবং জাতিসংঘের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান, জি-২০ এর সাথে কাজ করব। এটি সেই কাজের অংশ হবে যা আমরা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে করি, যেখানে অনেকগুলো নিয়ম সেট করা আছে।

৫. আমাদের নিজস্ব বাণিজ্য চুক্তি, সরবরাহ চেইন, শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং আমরা জোরপূর্বক শ্রম দিয়ে তৈরি পণ্য আমদানি করছি না—তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আমাদের যথাযথ পরিশ্রম এবং প্রয়োগের ব্যবস্থা করব।

সংবাদপত্রের বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা

১৬ নভেম্বর এই শ্রমনীতি ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই প্রায় প্রতি সংবাদপত্র একের পর এক স্যাংশনের ভয় দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। তারা এমনভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিছে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পের উপর যেন বিশাল কোন দুর্যোগ নেমে আসতে যাচ্ছে, যা সর্বৈব মিথ্যা ও মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা ষড়যন্ত্র বা অল্প জানার কুফল।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তৃক প্রেরিত রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি প্রকাশ করে সেটার ভুল ব্যাখ্যা করেও মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলছে শিক্ষিত ও স্মার্ট সাংবাদিকরা। ভিসা স্যাংশনের পর যে শুরু হয়েছে আমেরিকার স্যাংসনের জুজু, সেই জুজু দেখিয়ে বর্তমান সরকারের উপর অনাস্থা সৃষ্টি করতে এই প্রতিবেদনগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে টুইস্ট করে প্রচারিত হচ্ছে। নির্বাচন পূর্ব সংবাদমাধ্যমের রাজনীতির এই খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আর ভয়ার্ত অবস্থা বিরাজ করছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে।

তৈরি পোশাকশিল্প কি পশ্চিমা শ্রমনীতির বাইরে?

বিগত ৪ দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সার্বিক অবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি গার্মেন্টস বিদেশি বায়ারের সকল নীতি, যেটাকে বলা হয় কমপ্লায়েন্স, সেটা মেনেই পোশাক প্রস্তুত করে। এছাড়া বড় বড় পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনেক নির্দেশনা থাকে তৈরি পোশাক নির্মাতাদের জন্য। এগুলোর মধ্যে কাজের পরিবেশ থেকে শুরু করে, পণ্যের মান, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শ্রমিকদের বয়স, অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিবিধ নির্দেশনা থাকে; এবং সেগুলো মেনে চলছে কিনা সেটা নিয়ে আবার প্রতিটা বায়ার নিজস্ব লোক দিয়ে প্রতিটা গার্মেন্টস পরিদর্শন করায়। এই সকল পরিদর্শন শেষে, ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলেই সেই গার্মেন্টসে পণ্য প্রস্তুত করতে রাজি হয় পশ্চিমা বায়াররা। বাংলাদেশের কিছু কিছু গার্মেন্টস বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে কথা মাথা রেখে গাছপালা আচ্ছাদিত সবুজ গার্মেন্টস (green factories) তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশের সবচেয়ে বেশি সবুজ গার্মেন্টস এখন বাংলাদেশে অবস্থিত, এবং এই সংখ্যাটা ২০০’র উপর। আর এই নির্দেশনাগুলো মেনেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে বিশ্ব নন্দিত ব্র্যান্ডগুলো পোশাক তৈরি করে নিয়ে যায়। এতদিন ধরে মেনে আসা OCS & RCS Certificate, WRAP Certificate, ACCORD Recognition, H&M Gold Supplier, ISO 9001:2015, Compliance Certificate-সহ সকল সার্টিফিকেশন আর শ্রমনীতি মেনেই বাংলাদেশে পণ্য প্রস্তুত হচ্ছে আর সেগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত শ্রমনীতি এর বাইরের কিছু না। এটা শুধুমাত্র একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে পারে সেই সকল দেশের ওপর, বা প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যক্তির যারা উক্ত শ্রমনীতি অনুসরণ করছে না।

কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত "বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি" নিয়ে নতুন করে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আমূল বদলে গেছে। তবে ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো চিঠি অনুযায়ী একটু সতর্কতা অবলম্বন করা অবশ্যই জরুরি। কেননা এটা ইতিমধ্যে প্রতীয়মান হয়ে গেছে যে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে নিয়ে একটা নোংরা খেলায় নেমেছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি এবং অনমনীয় নেতৃত্ব চক্ষুশূল হয়েছে আমেরিকার জন্য। তাই তারা যেমন ভিসা স্যাংশন আরোপ করেছে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে, তেমনি তারা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর শ্রমিক অধিকারের দোহাই দিয়ে শাস্তি আরোপ করতেও পিছপা হবে না। তাই আমাদের সচেতন আর সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

ভুল, মিথ্যা খণ্ডিত তথ্য প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা বা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার এই যে অসাধু প্রক্রিয়া চলমান, এতে দেশের কোন লাভ হবে না বা হচ্ছে না। এতে লাভবান হবে বাংলাদেশবিরোধী শত্রুরা, যাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি সহ্য হয় না, যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে দেখতে চেয়েছিল!

এ সম্পর্কিত আরও খবর