বিভাজন, তবু স্বস্তির আশা

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-11-21 16:14:29

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দানের শেষ তারিখ। তফসিলের প্রথম সপ্তাহে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের জন্যে প্রস্তুতি রয়েছে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, নতুন নিবন্ধিত দল তৃণমূল বিএনপি দলীয় মনোনয়ন বিতরণ/বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। নামসর্বস্ব অনেকগুলো দল জোটবদ্ধ নির্বাচনে প্রতীক বিষয়ক ইসির চিঠির জবাব দিয়েছে, আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিও দিয়েছে। বিএনপি ও সমমনা দল ও জোটগুলো ইসির চিঠির জবাব দেয়নি।

নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনোকিছুতে বিএনপির না থাকার প্রথম কারণ দলটি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে আছে দলটি। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর দলটি আছে হরতাল-অবরোধসহ আন্দোলনে। তার ওপর দলটির মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা রয়েছেন কারাগারে, বাকিরা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে। বিএনপি চলছে মূলত জ্যেষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদের অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে। এরবাইরে আছে স্রেফ ঝটিকা মিছিল, চোরাগোপ্তা হামলা শেষে সেটা গণমাধ্যমে প্রেরণ।

দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি ও এর সমমনা দল আর জোটগুলো। আন্দোলন চলাকালে বিএনপির নেতৃত্ব শূন্যতার পাশাপাশি এখানে রয়েছে সরকারের কঠোর নীতি। প্রশাসনের ভূমিকা, আওয়ামী লীগের মাঠ দখলের ঘটনা এড়িয়ে বিএনপি পারেনি নিজেদের উপস্থিতি প্রমাণে। প্রবল নেতৃত্ব সংকটে থাকা দলটি এখন স্রেফ অপেক্ষা রয়েছে কাকতালীয় কিছু ঘটে যাওয়ার আশায়। আন্দোলনের এই তিন সপ্তাহে বিএনপির পক্ষে যায় এমন কিছু এখনো ঘটেনি। বরং হয়েছে তার উলটো। বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার’ দোহাই দিয়ে ইসি ঘোষণা করেছে নির্বাচনের তফসিল। আওয়ামী লীগ ও এর সমমনারা নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। বিএনপির আশা-ভরসা প্রতীক হয়ে ওঠা বিদেশি পক্ষগুলোর তৎপরতাও কমে গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বরং আগের চাইতে কম আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। ওখানকার যা আলোচনা সেটা একপ্রকার চর্বিত চর্বণ, ফলে দেশে গণমাধ্যমগুলোতেই মার্কিন অবস্থান আগের মতো গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হলেও পাঠক সেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না।

আন্দোলন শুরুর পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ওমর, মির্জা আব্বাস, শামসুজ্জামান দুদুসহ বিএনপি কয়েকজন নেতা নাশকতা মামলাসহ অপর বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে চলে গেছেন আত্মগোপনে। গ্রেপ্তারের তালিকায় আগে থেকেই ছিলেন আমানউল্লাহ আমান, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ আরও কয়েকজন নেতা। কিন্তু বিএনপির মতো বিশাল দল শীর্ষ কয়েকজন নেতার গ্রেপ্তারে নেতৃত্ব সংকটে পড়ে যায়। আন্দোলনের নেতৃত্ব এককভাবে চলে যায় রুহুল কবীর রিজভীর হাতে। তার বিরুদ্ধে মামলা এবং তিনি গ্রেপ্তার আতংকে থাকলেও তাকে ধরতে প্রশাসনের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। তিনি আগের মতো প্রেস বিজ্ঞপ্তি আর সংবাদ সম্মেলন সর্বস্ব আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির আগের আন্দোলনের ইতিহাস যদি আমরা দেখি, আগেও তিনি এমনভাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। অন্য অর্থে আবার এও বলা যায়, সরকার রুহুল কবীর রিজভীকে বড়ধরনের হুমকি বলে মনে করছে না, ফলে তার প্রতি অন্যদের মতো কঠোর নীতি দৃশ্যমান নয়।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপির সাফল্যের ইতিহাস নেই। তবু বিএনপির আন্দোলন চলমান। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে দাবিতে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া দলটির গত্যন্তরও নেই। আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এবার বিএনপির ‘বড় ভরসা’ হয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ যে বিদেশি শক্তিগুলো, তারাও শেষ মুহূর্তে এসে বিএনপির সঙ্গে আগের মতো আছে কিনা এনিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হুট করে ছুটিতে গেছেন গত কয়েক মাস ধরে নির্বাচন নিয়ে অতি-তৎপর ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। যদিও তিনি পূর্বনির্ধারিত ছুটিতে ঢাকা ত্যাগ করেছেন, তবে তার এই ছুটি বিএনপির মাঠ-পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকটাই হতাশ করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আলোচিত হয় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। জাতিসংঘ ও মার্কিন সেই ব্রিফিংয়ে বিএনপির পক্ষে নিয়মিত প্রশ্ন করে থাকেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারি মুশফিকুল ফজল আনসারি। আছেন আরও কয়েকজন। তাদের নিয়মিত প্রশ্নবাণে উত্তর দিতে হয় মার্কিন ও জাতিসংঘের মুখপাত্রদের। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার ও  প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল প্রতিবারই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে বলছেন, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোন দল-সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন নেই। তাদের লক্ষ্য একটাই বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সাংবাদিকেরা তাদেরকে বারবার টানছেন বলে তারা একাধিকবার মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, এই ধরনের প্রশ্নকে তারা স্বাগত জানান, কিন্তু এনিয়ে তারা মন্তব্য করবেন না। বিএনপির নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও এর বৈধতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ বাড়াবে কিনা, এমন এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল ম্যাথু মিলার বলেছেন, আমি আগেও বলেছি, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হোক, সবসময় এটাই আমাদের চাওয়া। কালও মিলার বলেছেন, নির্বাচন প্রসঙ্গে তাকে যতই টানা হোক না কেন তিনি এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখবেন। নির্দিষ্ট দল ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সকল প্রশ্নে তারা নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথাই বলছেন।

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খানিক অবস্থান পরিবর্তন সত্ত্বেও বিএনপি তাদের আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রেখেছে। সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসের চারদিনই রাখছে কর্মসূচি, মাঝে একদিন থাকছে বিরতি। এই কর্মসূচিগুলো পালিত হচ্ছে মিনিট খানেকের ঝটিকা মিছিল, কয়েক মিনিটের পিকেটিং আর বাসে আগুন দিয়ে তার ছবি ও ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশ পর্যন্তই। এভাবে কি আন্দোলন চলে? এভাবে কি সফল হওয়া সম্ভব? সম্ভব নয়!

এটা পরিষ্কার যে, আন্দোলনে থেকে অর্জনের কিছু নেই বিএনপির। এদিকে, আন্দোলন সত্ত্বেও একতরফাভাবে হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই একপাক্ষিক নির্বাচন দিয়েও আবার দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো যাবে না। বিপুল সংখ্যক নাগরিক ভোট থেকে বিরত থাকলে সেই নির্বাচনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠবে। যদিও এই প্রশ্ন নিয়েও আগামীর সরকার তার মেয়াদ পূরণ করে ফেলবে, এতে দেশের গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হবে, রাজনৈতিক সহনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেশিরভাগ সাধারণ নাগরিক এই পন্থা শোভন মনে করছে না।

উদ্ভূত পরিস্থিতি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ইঙ্গিত না দিলেও ধারণা করা হচ্ছে বরফ ক্রমে গলছে। গতকাল সোমবার নিজের দপ্তরে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এলে পুনঃতফসিল দেওয়ার কথা বিবেচনা করবে নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে আসার কথা জানাতে হবে।’  বিএনপি নির্বাচনে আসার কথা জানালে নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী সেটা বিবেচনা করবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে আমার জানামতে, ওনারা আসছিলেন। ওই নির্বাচনে কিন্তু ওনাদের জন্য একটু স্পেস তৈরি করা হয়েছিল। যেভাবে আইনে আছে, আমরা সেভাবেই করব।’ এরবাইরে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এমপি গত রোববার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পুনঃতফসিলের অনুরোধ জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার এই প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন।

আন্দোলনে, নেতৃত্ব সংকটে, নেতারা আত্মগোপনে থাকায় এই মহূর্তে বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি নেই। নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সক্রিয় নেতাও নেই এখন দলটির। গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন শুনানি ছিল, কিন্তু পাবলিক প্রসিকিউটর অসুস্থ ও তার আইনজীবীরা এক সপ্তাহ সময় প্রার্থনা করায় শুনানি হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে আসছে সপ্তাহে জামিনসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে নতুন কোন সিদ্ধান্ত আসতেও পারে।

মাঠের রাজনীতি, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশনারের ইঙ্গিত, রওশনের অনুরোধকে রাষ্ট্রপতির ইতিবাচকভাবে গ্রহণ, মির্জা ফখরুলের জামিন নিয়ে নানা ঘটনা বলছে, আসছে সপ্তাহ হতে যাচ্ছে নতুন এবং আশাবাদী হওয়ার মতো। বিভাজনের রাজনীতি আশাবাদকে উলটপালট করে দেয় সত্য, তবে কথায় আছে—‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই,পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’! আমাদের সামনে ‘অমূল্য রতন’ নাই ঠিক, তবে যা আছে তার মূল্য কিন্তু কম নয়!

এ সম্পর্কিত আরও খবর