বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন মিথ ভেঙে টুকরো করেছে ভারত

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ঋত্তিক মুখোপাধ্যায় | 2023-11-15 13:32:48

দুয়ে-দুয়ে যে চার হয়-তা তো আমরা ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি। আর এবারের মার্কিন-ভারত টু-প্লাস-টু মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পরে দুয়ে-দুয়ে চার করে যেটা খুব সহজেই পরিষ্কার হয়েছে তা হল ভারত তার প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে শক্তপোক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে। এও পরিষ্কার হয়েছে যে বাংলাদেশে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য কিছু দেশের নাক-গলানো ভারত একেবারেই ভালো চোখে দেখছে না। মনে রাখতে হবে টু+টু মিনিস্টেরিয়াল ডায়ালগ একটা কূটনৈতিক শীর্ষ বৈঠক, যেটা ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছর হয়ে আসছে।

এবারের সাম্প্রতিকতম এই শীর্ষ বৈঠকের শেষে ভারতের বিদেশ সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সরকারিভাবে জানিয়েছেন যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্তরের এই শীর্ষ বৈঠকে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত তার মনোভাব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে।

আর কি সেই মনোভাব? ভারত জানিয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনাকাঙ্ক্ষিত নাক-গলানো শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সামগ্রিক ভাবে আঞ্চলিক শান্তি, সুরক্ষা, স্থায়িত্বের জন্য বিপজ্জনক। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের ক্ষেত্রেও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। বাংলাদেশের নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য কিছু পশ্চিমী দেশের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ তাদের জন্য ব্যুমেরাং হয়ে উঠতে পারে বলেও ভারত জানিয়েছে।

পুরো বিষয়টা নিয়ে জলঘোলা হতে শুরু করে- যখন বিরোধী নেতা-নেত্রী দাবি করতে শুরু করেন যে সে দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করাতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু পশ্চিমী দেশ সেই সুরে সুর মেলাতে শুরু করে দেয়।

এই পরিস্থিতিতে ভারতের মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশ সরকারকে শুধু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেই সাহায্য করেনি, তাদের মনোবল বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আসলে এই মুহুর্তে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার পর ভারতের মতামতকে কোনও দেশই আর উপেক্ষা করতে পারছে না। এখানে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ভারত শুধু বাংলাদেশ কেই সাহায্য করছে না, কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের অবস্থান অনেক উন্নীত এবং মজবুত হচ্ছে । যে কোনও আন্তর্জাতিক বিষয়ে পশ্চিমী দেশগুলি সর্বশক্তিমান এবং অন্যান্য ছোট দেশগুলিকে পশ্চিমী দেশগুলির অভিমত ধ্রুব সত্য এবং দূর্লঙ্ঘ হিসাবে মেনে চলতে হবে- দীর্ঘদিন ধরে চলে-আসা এই 'মিথ্'-কে ভারত যেন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। 

ভেবে দেখুন একবার, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তখন হাসিনা কি জবাব দিয়েছিলেন? হাসিনা পরিষ্কার জানিয়ে দেন- মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন আগে সে দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসুন, তাহলে তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা ভাববেন। বাংলাদেশ সরকারের ওপর ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছাড়া এই ধরনের জবাব দেওয়া অতটা সহজ হ'ত না। ভারতের সমর্থনের পরই যে পশ্চিমী দেশগুলির অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে -এমনটা মনে করা সঠিক নয়। কিন্তু এর ফলে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার যে এই সমস্ত বহিরাগত চাপ উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ানোর সাহস পাবে -এ কথা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে।

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক, আর্থিক, বাণিজ্যিক, এবং সামগ্রিক পারস্পরিক সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ শিখরে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিয়মিত সরাসরি যোগাযোগ বা বৈঠক হয়। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা গত কয়েক মাসে একাধিকবার শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং ভারতের মনোভাব বিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী সরকার শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর এস এস), যাদের এই সরকারের মূল চালিকা শক্তি বলে মনে করা হয়, তারাও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের স্থায়িত্ব এবং ধারাবাহিকতা চায়। বাংলাদেশের বিএনপির সঙ্গে ইসলামিক মৌলবাদী শক্তিদের যোগাযোগ নিয়েও ভারত সরকার বা আর এস এস কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় করেনি।

পরপর তিনবার শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতার মসনদে আসীন। এই চতুর্থবার তিনি এবং তার দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের লক্ষ্যে এগুচ্ছে। আর এই প্রেক্ষাপটে টু-প্লাস-টু বৈঠকে ভারতের অবস্থান এবং ভারতের বিদেশ সচিবের মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।  ভারত যে শেখ হাসিনার পুনর্নিবাচনের পক্ষে - তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের বিরোধী দল- বিএনপি এবং তার সহযোগী দল -জামায়াতে ইসলামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক মনোভাব, বিশেষ করে পিটার হাসের কিছু সাম্প্রতিক ক্রিয়াকলাপকে নিজেদের যুক্তি এবং দাবির স্বপক্ষে একটা 'ন্যারেটিভ' তৈরির কাজে ভীষণ ভাবে ব্যবহার করছিল। কিন্তু ভারত তার অবস্থান পরিষ্কার করার পর যেন চাকা উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করেছে। টু-প্লাস-টু মন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ বৈঠকে ও ভারত, বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এবং সমর্থনে নিজেদের যুক্তি জোরালো ভাবে দাঁড় করিয়েছে। শুধু তাই নয়, তথ্যভিজ্ঞ মহলের ধারণা, ভারত, মার্কিন প্রশাসনকে এটা বোঝাতে চেয়েছে এবং পেরেছে যে মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গী থেকেও এই উপমহাদেশের শান্তি, সুরক্ষার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতিতে ও এই নয়া নীতি এবং কৌশল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ভারতীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর