ডোনাল্ড লুর চিঠি আমেরিকার ‘এক্সিট প্ল্যান’ নয় তো?

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-11-15 00:04:59

বাংলাদেশের তিন প্রধান রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর দেওয়া চিঠি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এর প্রধান বার্তাবাহক ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

গতকাল সোমবার (১৩ নভেম্বর) ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি ডোনাল্ড লুর এই চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত করে না পুনরুল্লেখ করে ইবেলি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষকে কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়া সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা করা ভিসা নীতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

হাতে হাতে চিঠি পৌঁছে দিয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেও এসেছেন। বৈঠক প্রসঙ্গে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চিঠিতে মূলত অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন; শর্তহীনভাবে সংলাপ; এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি গ্রহণ করেছে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাপা মহাসচিব জানান, জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দলগতভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চাইতে পারে। তবে নির্বাচন কেমন হবে, সেটা আমাদের নিজস্ব বিষয়।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ চিঠি প্রাপ্তির তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, তবে চিঠি নিয়ে কোন মন্তব্য এখনো করেননি। ধারণা করা হচ্ছে, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত লন্ডন থেকে আসার পর বিএনপি চিঠি বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেবে। এদিকে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ফারুক খান সোমবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা এখনো চিঠি পাননি, এবং চিঠি পেলে তারাও তাদের বক্তব্য জানাবেন। অর্থাৎ তিন দলই এখনো চিঠি বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ কিংবা অস্থিরতা বেশ কয়েক মাস ধরে চলছে। ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে’ দেশটি বাংলাদেশিদের জন্যে ভিসানীতিও দিয়েছে, যেখানে নির্বাচন বানচাল ও কারচুপির প্রচেষ্টাকারীদের তারা ভিসা দেবে না বলেও উল্লেখ করেছে। মার্কিনীদের এই ভিসানীতি কিছুদিন আগেও টক অব দ্য কান্ট্রি ছিল। চারদিকে হা-রে-রে রব ওঠায় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশিদের লক্ষ্য বুঝি আমেরিকার একটা ভিসাই কেবল। এরইমধ্যে অবশ্য এই হাহাকার কমে এসেছে। তবে চাপা শঙ্কা আছে অনেকের মাঝে, যদিও কারণটা অজানা। এমন অনেকেও আছেন শঙ্কায় যাদের ভাবনাতে নেই কিংবা ছিল না আমেরিকার ভিসা, তবু ভিসা-জুজু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে অনেককে। ইত্যবসরে গুজবও ছড়াল এরইমধ্যে নাকি অনেকেই ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়ে গেছেন। সামাজিক মাধ্যমে এমন অনেকের নামও ছড়াল যারা সরকারের অংশ, কিন্তু দেখা গেল তাদের কজন এরইমধ্যে আমেরিকা সফরে গিয়ে দেশটির অনেকের সঙ্গে বৈঠকও করে এসেছেন। এতকিছুর পরেও কিন্তু শঙ্কা আছে অনেকের মাঝে, গুজবও আছে। তার ওপর আছে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ব্যাপক তৎপরতা।

পিটার হাস গত ক’মাসে যে তৎপরতা দেখিয়েছেন এবং দেখিয়ে যাচ্ছেন তাতে এটা তার স্বাভাবিক কূটনৈতিক তৎপরতা মানতে নারাজ অনেকেই। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তার আগ্রহ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনের জন্যে এটা যতখানি তার আগ্রহ, তারচেয়ে বেশি অস্থিরতা বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, নির্বাচন কমিশনসহ নানা জায়গায় যাচ্ছেন, কথা বলছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে। গণমাধ্যমও তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। তিনি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর সংলাপের প্রসঙ্গ এনেছেন, যদিও তাৎক্ষণিক অন্য এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের অনানুষ্ঠানিক আহবান কিংবা সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যদি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সংলাপে বসেন তবে তিনিও বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করবেন বলে যে মন্তব্য করেছেন সেটা ওয়াশিংটনের প্রেস ব্রিফিংয়েও বিএনপি-ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক তুলেছিলেন, যদিও মার্কিনীদের পক্ষ থেকে এনিয়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি।

পিটার হাসের সেই সংলাপের প্রস্তাব শুরুতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এবার ফের সামনে এসেছে ডোনাল্ড লুর চিঠিতে। এবার অবশ্য আনুষ্ঠানিক, এবং সেটা পিটার হাসের থেকে অনেক উচ্চ পর্যায় থেকে। এখানে মার্কিনীরা সংলাপের কথা বলল, আবার একই সঙ্গে ভিসানীতির ভয়ও দেখাল বলে মনে করা হচ্ছে। অথচ ভিসানীতির বিষয়টি অতি-আলোচনায় সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটাই আবেদনহীন। এবং ভিসানীতি জনিত যে ভয় সেটা সরকার এরইমধ্যে কাটাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই ভয় কাটানো হয়েছে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো থেকে, যারা কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

ডোনাল্ড লুর সদ্য পাঠানো চিঠি নিয়ে সরকার ও বিএনপি নিশ্চয় বক্তব্য দেবে। তবে এই চিঠি যে সংলাপের পথ খুলে দেবে, এটা ভাবার কারণ নাই। কারণ বিএনপি ও সমমনা জোটগুলোর চলমান আন্দোলন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি, বরং বিএনপিই পড়ে গেছে বেকায়দায়। ২৮ অক্টোবরের বিপুল জনসমাগম করেও মহাসমাবেশ সফল করতে না পেরে বিএনপি ও এর সমমনা দল-জোটগুলো আছে অবরোধ কর্মসূচিতে। এই কর্মসূচিতেও প্রশাসনের কঠোর ভূমিকার কারণে মাঠে নামতে পারছে না বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলের নেতাদের প্রায় সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরছাড়া।

মাঠের রাজনীতিতে বিএনপিকে কোণঠাসা করে রেখে আওয়ামী লীগ সরকার আবার কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও কিছুটা সফল হয়েছে ভারতে অনুষ্ঠিত টু প্লাস টু বৈঠকে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বিবিধ বিষয়ে আলোচনায় বসেছিল। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ভারতের অবস্থান ও যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া বার্তায় অনেকটাই স্বস্তিতে আছে সরকার। আওয়ামী লীগ মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া ভারতের বার্তায় বাংলাদেশে মার্কিনীদের খবরদারি প্রচেষ্টা অনেকটাই খর্ব হবে। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সংলাপের এই চিঠি, ভিসানীতির ভয় দেখানো সরকারকে প্রভাবিত করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

বিএনপির চলমান আন্দোলন এক দফা দাবির। এই এক দফায় তারা চায় সরকারের পদত্যাগ। আওয়ামী লীগ শুরুতেই পদত্যাগের দাবিকে আমলে না দিয়ে সাংবিধানিক ব্যবস্থায় থাকা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও ইতোমধ্যে নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। দিন কয়েকের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হবে বলে ধারণাও করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় এই সংলাপের আহবান খুব বেশি যে প্রভাব ফেলতে পারবে, তেমনটা মনে হচ্ছে না।

সংলাপ হবে কাদের সঙ্গে? সংলাপ হলেই বা এর ভবিষ্যৎ কী? নির্বাচন কমিশন এ মাসের শুরুতে যে সংলাপের আয়োজন করেছিল সেখানে যায়নি বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো। নির্বাচন কমিশন নতুন করে আর সংলাপের আয়োজন করবে না। তাহলে বাকি থাকল সরকারের সঙ্গে বাকি দলগুলোর সংলাপ। এটাও সম্ভব হবে না, কারণ বিএনপির মূল দাবিই যেখানে সরকারের পদত্যাগ, সেখানে তাদের সংলাপে বসা মানে পদত্যাগের দাবি থেকে সরে আসা। দলটি এমনটা করবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে সংলাপের যে আহবান সেটা শেষ পর্যন্ত চিঠিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর এই চিঠি এসেছে ভারতে অনুষ্ঠিত টু প্লাস টু বৈঠকের পর। এই চিঠি কি তবে ওই বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া সবশেষ ভূমিকা? চিঠিতে ভিসানীতি কার্যকরের ভয় দেখানো কি তবে বাংলাদেশের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে আমেরিকার ‘এক্সিট প্ল্যান’?

কঠিন ভবিষ্যতের ভয় দেখিয়ে বর্তমান থেকে আস্তে আস্তে সরে যাওয়ার বিষয়টিও তবে ওড়িয়ে দেওয়া যায় না!

এ সম্পর্কিত আরও খবর