দায়িত্বশীলদের মুখের লাগাম ও তোফায়েল আহমেদের সেই উক্তি

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2023-11-10 20:53:31

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়বার তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল সংসদ সদস্য পদ ছাড়েন তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার তথা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদের পুত্র সোহেল তাজের অভিমানী এই পদত্যাগ দেশের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা। যদিও সোহেল তাজের মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে গেলেও তার বোন সিমিন হোসেন রিমিকে ফের মনোনয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘাটি কাপাসিয়ায় তাজউদ্দিনের পরম্পরাকেই বহাল রাখে দল।

সোহেল তাজের ঘটনাবহুল পদত্যাগে দলের ইমেজ ধরে রাখতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সিমিন হোসেন রিমির নির্বাচন পরিচালনায় প্রধান সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে হেভিওয়েট নেতা তোফায়েল আহমেদকে সামনে নিয়ে আসেন। মেয়াদের শেষান্তে এসে সেই সময়টিতে তোফায়েল আহমেদ ও ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে মন্ত্রী হিসেবে ‘পুরস্কৃত’ করে দল ও জোটের অন্দরের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ। স্বভাবতোই এ নিয়ে সেই সময়ে দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মতোই গণমাধ্যমের অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক তোফায়েল-মেননের মন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি।

উপ-নির্বাচনে সিমিন হোসেন রিমির ভোটের ডামাঢোলের মধ্যেই আমরা কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী তোফায়েল আহমেদের সাথে কথা বলতে তার বনানীর বাসভবনে যাই। গণমাধ্যম বান্ধব তোফায়েল আহমেদ সেদিন বেশ মুখভার করে গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে এসেছিলেন। খুব একটা প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই তিনি ক্ষুব্ধস্বরে বলতে শুরু করেন, ‘বাংলাদেশের যতো সমস্যা এই কথা বলা নিয়ে, আমি মুহিত সাহেব (প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত) না’।

ব্যস …এটুকুই। আমাদের আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি প্রস্থান করলেন, যাওয়ার সময় সহকারীকে বলে গেলেন, আমরা যেন সবাই মিষ্টিমুখ করে তবেই ফিরি। সেদিন আমরা মিষ্টি খেয়েছিলাম কিনা মনে নেই, তবে জ্যেষ্ঠ এই রাজনীতিকের কথাটি কানে গেঁথে গিয়েছিল।

এখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অন্তঃসারশূন্যতা এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে খুবই সাধারণ শিষ্ঠাচার, মূল্যবোধের চর্চাও আজ হারিয়ে গেছে!

গতকাল (৮ নভেম্বর) থেকে স্যোশাল মিডিয়ায়, রাস্তাঘাটে, ট্রাফিক জ্যামে, এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেকে সরকারের একজন মন্ত্রীর দায়িত্বহীন অসার মন্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বাণিজ্য মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য টিপু মুন্সী সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি মনিটরিং ও রিভিউ কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নিজ অঞ্চলের রংপুরের মানুষদের জীবন-যাপনের প্রাচুর্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলে উঠেন, ‘আমার এলাকায় কেউ কষ্টে নেই, নারীরা তিনবার লিপস্টিক লাগাচ্ছে।’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যেখানে সাধারণ মানুষ, এমনকি মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠার যোগাড়; সেখানে সরকারের দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রীর এমন অবিবেচক মন্তব্য সাধারণের ক্ষোভ উগরে দেবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বিগত বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রীদের অপ্রয়োজনীয় বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিযোগিতা দেখে আসছি। সেই পরম্পরা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যে স্থিতিশীল রাজনৈতিক চর্চার জন্য বড় অন্তরায় এসব অর্বাচনী মন্তব্য। মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতাদের এই কথার লড়াই গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ আয়োজনের পুরো ভাগকে দখল করে জনগুরুত্বপূর্ণ বা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খবরের জায়গাগুলোকে যেভাবে সংকুচিত করে দিচ্ছে তা হয়তো কেউ ভেবেই দেখছেন না। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের যারা রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন সেই নবাগতরাও একই সংস্কৃতিকে ধারণ করে অর্বাচীন বাকযুদ্ধে জড়িয়ে ভবিষ্যত রাজনীতিকে ক্রমেই সংঘাতপ্রবণ করে তুলছেন।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই দেখতে পাবো, স্বাধীনতা উন্মূখ পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা হিসেবে একজন শেখ মুজিবুর রহমান তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের গুণে সমগ্র পাকিস্তান জুড়েই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। যার ফলে আমরা দেখব মুজিব ‘সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে বক্তৃতা করছেন উদাত্ত কণ্ঠে। কিন্তু বাঙালির বঙ্গবন্ধু মুজিব যখন তার জনগণের শোষক পাক শাসকদের কড়া জবাব দিচ্ছেন তখনো তিনি বক্তৃতায় কতোটা বিনয়ী ভাষায় সম্বোধন করে বলছেন, ‘জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি আসুন, দেখে যান, কিভাবে আমার লোককে হত্যা করা হয়েছে…’

কিন্তু আজ রাজনীতির মাঠে গরম বক্তৃতা দেওয়ার যে ‘রেওয়াজ’ তাতে এই পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের সামান্য লেশমাত্র নেই! গণতান্ত্রিক দেশে জনগণই যদি সব ক্ষমতার মালিক হন তবে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষদের দুঃখ লাঘবে সক্ষম না হলেও তাদের দুর্গতি নিয়ে উপহাস করবার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?

বাণিজ্যমন্ত্রী মহাশয় যে উক্তি করেছেন, তা হয়তো একটি শ্রেণির মানুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতেই পারে, তবে তা যে শতভাগ মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় তা চ্যালেঞ্জ করেই বলা যাবে। তাহলে সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের সক্ষমতার অসমতাকে না মেনে নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে আপনি আপনার শপথকেই অশ্রদ্ধা করলেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে একটি জাতি নিরঙ্কুশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক যে সার্বভৌম ভূ-খণ্ড পেয়েছিল তার প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি সমতার সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমরা একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে পরিণত হলেও আমরা যে মহান মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠা থেকে অনেকদূরে অবস্থান করছি তা নিয়ে কারোর মাঝেই সংশয় থাকার কথা নয়।

অর্থপাচার, ঋণ কেলেঙ্কারি, সিন্ডিকেটবাজিসহ সুশাসনের অন্তরায় যতো প্রসঙ্গ রয়েছে সেদিকে নজর না দিয়ে, সেইসব দায়িত্ব ভুলে গিয়ে জনগণের অসহায়ত্বকে উপহাস করার প্রবণতায় কেবল বাণিজ্যমন্ত্রীকেও আমরা প্রথমবার দেখেছি এমনটাও কিন্তু নয়। এই ধরণের প্রবণতা হরহামেশাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু সরকার ‘মাননীয় মন্ত্রীদের’ মুখে লাগাম টানতে ব্যর্থ। সদ্য স্বাধীন দেশে বিদেশের কারাগার থেকে ফিরে ক্লান্ত বঙ্গবন্ধু যেভাবে গর্জে উঠে বলেছিলেন, ‘এসব মুনাফাখোরি-চোরাকারবারিদের আমি চূড়ান্ত আঘাত হানতে চাই’।

কই আমরা তো এই উচ্চারণ আপনাদের কারোর মাঝে দেখি না! আধুনিক প্রযুক্তি-জ্ঞানের প্রাচুর্যে সজ্জিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকেও আমরা কেন চোরাকারবারিদের ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি? এদের লাগাম যেমন টানা যাচ্ছে না তেমনি পাল্লা দিয়ে আপনার মুখের লাগামও দেওয়া যাচ্ছে না। তখন কেবলি প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদের উক্তি মনে পড়ে, ‘বাংলাদেশের যতো সমস্যা এই কথা বলা নিয়ে’।

এ সম্পর্কিত আরও খবর