ভয়ের পরিবেশে চিড়েচ্যাপটা জনতা

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-11-01 17:38:42

ভয়ের রাজনীতি এবং অথবা ভয় দেখানোর রাজনীতি শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগেও ছিল যা কেবল বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ। এখন তা মাঠের অনুবাদে। হরতালের পর একদিন বিরতি দিয়ে তিন দিনের অবরোধের প্রথম দিনেই এর স্বরূপ উন্মোচন হয়েছে। প্রথম দিনেই দেশের নানা প্রান্তের আগুনের ঘটনা ঘটেছে, নাশকতা ঘটেছে, সংঘর্ষ ও প্রাণ আর সম্পদের অপচয় হয়েছে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তবে এটা নিশ্চিত ভয়ের। এটা ভয়ের রাজনীতি সূচনা। বলা যায়, প্রায় এক দশকের বিরতি দিয়ে ফের দেশে ফিরেছে ভয়ের পরিবেশ।

২০১৩-১৪ সালের ভয়ের সেই পরিবেশ এখনো নাড়া দেয়। সে সময়ের ভীতির পরিবেশে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছিল। বাসে আগুন, পেট্রল বোমায় অগণন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। তখনো সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ, বিরোধীদলের ভূমিকায় বিএনপি-জামায়াত; এখনো তাই। তখনো ছিল নির্বাচনের আগে-পরের পরিবেশ, এখনো এর ব্যতিক্রম নয়। শেষ পর্যন্ত আগুনের সেই কাল শেষ হয়েছে, তবু প্রাণ আর সম্পদের যে অপচয় হয়েছে সেটা অপূরণীয়।

নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ছিল তখনো দাবি, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি সংবিধানসম্মত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিএনপি-জামায়াত সে বার নির্বাচন বর্জন করেছিল। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিরোধীদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে সরকার মেয়াদ পূর্ণ করেছিল। পরের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ছিল, তবে তাতে তাদের ব্যাপক ভরাডুবি ঘটেছিল। এককভাবে সরকার গঠন করে পূর্ণ মেয়াদের দিকে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৯ জানুয়ারি সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে নির্বাচনের যে বাধ্যবাধকতা নির্বাচন কমিশনের সেই ক্ষণগণনা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি বলেছেন, প্রতিকুল পরিবেশ হলেও যথাসময়ে নির্বাচন করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। এরই মধ্যে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাজগুলো শুরু হয়েছে। অর্থাৎ প্রশাসনিকভাবে দেশ এগুচ্ছে নির্বাচনের দিকে।

যথাসময়ে নির্বাচন না হলে দেশ পড়বে সাংবিধানিক সংকটে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন আয়োজনের। তারা সে পথেই আছে। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি তাতে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দেশব্যাপী অরাজকতা-নাশকতার পাশাপাশি আমেরিকাসহ কিছু অতি-উৎসাহী মহলের দৌড়ঝাঁপ বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

এই বিভ্রান্তির শুরু মূলত আমেরিকার ভিসানীতি। সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে আমেরিকা বাংলাদেশিদের জন্যে যে ভিসানীতি দিয়েছে, সেটাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে এই মুহূর্তের রাজনীতি। সরকার দল আওয়ামী লীগ যতই অস্বীকার কিংবা বিষয়টি হালকাভাবে দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন তারাও এর দ্বারা প্রভাবিত। ২৮ অক্টোবর বিএনপিকে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের অনুমতি দেওয়া থেকে শুরু করে অপরাপর সরকারি সিদ্ধান্তগুলো নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করলে সেটাই প্রকাশ্য হয়। বিএনপির রাজনীতির প্রধান লক্ষ্যই এখন আমেরিকা-তুষ্টি, এটা তারা জোরালোভাবে প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি আগ্রাসনে পর্যুদস্ত হলেও বিএনপি টু-শব্দটি করেনি, পাছে আমেরিকা রুষ্ট হয়। আছে তাদের নালিশের রাজনীতি, যার প্রধান লক্ষ্য আমেরিকার সহানুভূতি।

ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত কয়েক মাস ধরে যা করছেন সেটা কি কোন রাষ্ট্রদূতের কাজের মধ্যে পড়ে? বাংলাদেশে আমেরিকার প্রতিনিধি তিনি। রাষ্ট্রদূতের কাজ কোন দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলা না, কারা সরকারে থাকবে, কারা থাকবে না, কী প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে এটা কোন দেশের কোন রাষ্ট্রদূতের কাজ না। তিনি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি সংলাপ আয়োজনের পরামর্শ দিচ্ছেন, বাইরে এসেও বলছেন সে সব কথা। অথচ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা নির্বাচন কমিশন এবং সরকার আর রাজনৈতিক দলগুলোর। এখানে তিনি কোন পক্ষ নন, অথচ মুরুব্বি সাজছেন। তিনি আমন্ত্রিত নন, পেশাগত দায়িত্বে বাংলাদেশে এসেছেন; তার কাজও বিধিবদ্ধ। কিন্তু তিনি তার কাজের বাইরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অহেতুক কথা বলছেন, হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন। এটা আর যাই হোক আমাদের আত্মসম্মানবোধে বড়ধরনের নাড়া দিচ্ছে। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরামর্শ আমরা নিতে পারি কারো, কিন্তু পরামর্শের নামে যা মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে হচ্ছে সেটা স্রেফ হস্তক্ষেপের চেষ্টাই।

পিটার হাসের এই তৎপরতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এরইমধ্যে বলেছেন, আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব এবার তাদের সাহস যোগাচ্ছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেছেন, পিটার হাস অবতার হয়ে এসেছেন!

এই যে ভয়ের পরিবেশের সৃষ্টির চেষ্টা সেটা কি তবে সেই সাহস থেকে উদ্ভূত। যে বিএনপি-জামায়াত গত এক দশকে মাঠে নামার চেষ্টা করেনি, নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তারা মাঠে নেমে কেন এত যুদ্ধংদেহী? আওয়ামী লীগ পুরোটা সময় আন্দোলন নিয়ে বিএনপিকে উপহাস করেছে। খেলা হবে খেলা হবে—এমন চটুল অথচ অরাজনৈতিক শব্দ-বাক্য উচ্চারণ করেছে। এখন আবার আন্দোলন মোকাবেলায় কৌশলে আইন-প্রশাসনকে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলার দায়ে বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করছে, গ্রেপ্তার করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে মির্জা আব্বাস, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ বিএনপি কেন্দ্রীয় অনেক নেতা কারাগারে। এরবাইরে যারা আছেন তারাও গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে।

আলোচিত ২৮ অক্টোবরের পর হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দল ও জোটগুলো। অবরোধের প্রথম দিনে সারাদেশে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। প্রথম দিনের সহিংসতায় তিনজন নিহত এবং অন্তত ৮২ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে দুজন নিহত এবং ১০ পুলিশসহ আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। অন্যদিকে সিলেটে পিকেটিংয়ের সময় পুলিশের ধাওয়ায় এক যুবদল নেতার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ, যানবাহনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নাশকতার অভিযোগে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা হয়েছে।

বুধবার ফায়ার সার্ভিস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ১ নভেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৭ ঘণ্টায় বাস, ট্রাক, পিকআপ, বাণিজ্যিক পণ্যের শো রুম, একটি পুলিশ বক্সসহ ১৬ জায়গায় আগুন দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা মহানগরে ৪টি, ঢাকা বিভাগে ৬টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩টি, রাজশাহী বিভাগ ৩টি ঘটনা। এসব ঘটনায় ৯টি বাস, ২টি কাভার্ড ভ্যান, ২টি ট্রাক, ১টি পিকআপ, ২টি বাণিজ্যিক পণ্যের শো রুম, ১টি পুলিশ বক্স পুড়ে যায়। এই তথ্য আদতে ফায়ার সার্ভিস যেখানে অংশ নিয়েছে তার। এরবাইরে দেশের নানা জায়গায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি তথ্যে যা আসছে, প্রকৃত অবস্থা তার চেয়ে নাজুক ও সহিংস। দেশের এই যে অবস্থা এটা সেই ভয়ের পরিবেশে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত। অপ্রত্যাশিত হলেও আমরা হয়তো সেই পথে এগুচ্ছি।

তিন দিনের অবরোধের দ্বিতীয় দিন আজ। সামনে আরেক ভয়াবহ দিন। সহিংসতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা প্রবল। ভয়ের পরিবেশের যে সূচনা হলো সেখান থেকে উত্তরণ আদতে কোন পথে? এই কদিন বিএনপি-জামায়াতের উদ্ধত-কর্মীদের কারণে সরকার পেয়ে গেছে আন্দোলন মোকাবেলার রসদ, বিএনপি-জামায়াত পেয়ে গেছে লাশ। দুপক্ষই নিজেদের প্রয়োজনে সেটাই ব্যবহার করবে। এদিকে, হরতাল-অবরোধের চাপে বিড়ম্বনায়-প্রাণভয়ে, ভয়ের পরিবেশে চিড়েচ্যাপটা জনগণ!

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম: ইমেইল: kabiraahmed007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর