মিয়ানমার সরকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ: রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কতদূর?

, যুক্তিতর্ক

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন | 2023-10-31 17:39:18

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থায় গাজায় ইসরাইলের নৃশংস হামলা শুরু হয়েছে আর একই সাথে বাড়ছে নিরীহ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ। সারা বিশ্বের মনোযোগ এখন গাজার নির্মম ভয়াবহতার দিকে। এভাবেই পৃথিবীতে শান্তির বদলে একের পর এক প্রাকৃতিক ও মানুষ সৃষ্ট দুর্ভোগ লেগেই রয়েছে। দিন দিন দুর্ভোগের তীব্রতা বেড়েই যাচ্ছে কিন্তু আগের চলমান সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। এর ফলে একটু পুরানো হয়ে যাওয়া সমস্যা নতুন সমস্যার পেছনে চলে যাচ্ছে ও সেসব সমস্যা মনোযোগ ও গুরুত্ব হারাচ্ছে। মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতা চলমান এবং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটে বিপর্যস্ত। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সমস্যার সমাধান না হওয়ায় এগুলো নতুন সমস্যার আবর্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হওয়ার আগে বিশ্বকে তা কোন ভাবেই ভুলতে দেয়া যাবে না।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং চলমান সংঘাতের মধ্যে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৫ অক্টোবর মিয়ানমার সামরিক সরকার বহু পক্ষীয় যুদ্ধ বিরতি চুক্তি (এনসিএ) স্বাক্ষরের অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানায়। ২০২১ সালের ১ফেব্রুয়ারি অংসান সুচি'র নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর এই অনুষ্ঠানটি ছিল সামরিক সরকার এবং জাতিগত সংখ্যালঘু নেতাদের সাথে প্রথম এই ধরনের আনুষ্ঠানিক সমাবেশ৷

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে থেকে বহু জাতিগত সেনাবাহিনী তাদের অঞ্চলের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের জন্য জাতিগত ভামার সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। মিয়ানমারে সরকারের সাথে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমঝোতার ফসল এনসিএ সহজে অর্জিত হয়নি। শান্তি আলোচনার জন্য দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো থেকে এর সমাপ্তিতে ১৪৫০ দিন লেগেছে। এইদিন গুলিতে,  ছোট ছোট আলোচনা ও সমঝোতাসহ ৫০০০টিরও বেশি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই প্রায় ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতের শিকার এবং তা এখনও চলমান।

২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে আটটি জাতিগত সশস্ত্রগোষ্ঠী এনসিএ স্বাক্ষর করে, পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরো দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী অং সান সু চির বেসামরিক সরকারের অধীনে যুদ্ধ বিরতিতে যোগ দেয় ও সবমিলিয়ে ১০ টি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহের অবসানের একটি পদক্ষেপ হিসাবে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল। মিয়ানমারের সামরিক সরকার গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বিরোধীদের থেকে দেশব্যাপী সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির একটি জোট চীন সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় সামরিক লক্ষ্যবস্তু দখল করতে উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারে একটি সমন্বিত আক্রমণ শুরু করেছে। সামরিক বাহিনীও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোতে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

এই অনুষ্ঠানে ডেমোক্র্যাটিক কারেন বৌদ্ধ আর্মি, কেএনইউ/কেএনএলএপিস কাউন্সিল, ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, আরাকান লিবারেশন পার্টি, শান স্টেটের রিস্টোরেশন কাউন্সিল, নিউ মনস্টেট পার্টি, লাহু ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নসহ সাতটি স্বাক্ষরকারী গোষ্ঠী তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। তবে বর্তমান সেনা সমর্থিত শাসনের বিরোধিতাকারী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন, চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং অল বার্মা স্টুডেন্টস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, এই তিনটি স্বাক্ষরকারী দল এই অনুষ্ঠানটি বয়কট করে।

এই অনুষ্ঠানকে সফল করার লক্ষ্যে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার সামরিক শাসন বিরোধী জোটকে দুর্বল ও বিভক্ত করার জন্য ২০২২ সালের মে মাস থেকে জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নেতাদের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে একের পর এক শান্তি আলোচনার আয়োজন করে। মিয়ানমারে ২১টি প্রতিষ্ঠিত জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে, এর মধ্যে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি এবং ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিসহ কয়েকটি বড় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সমর্থন করেনি। এই তিনটি দল গণতন্ত্রপন্থী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পি ডি এফ) সাথে জোট করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক বাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এই তিনটি গ্রুপ একটি যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছে যে চুক্তিটি আর বৈধ নয় এবং সরকার চলমান সহিংসতা বন্ধ না করা পর্যন্ত তারা এনসিএ শান্তি আলোচনায় যোগ দেবে না। এর কারণ হিসেবে তারা জানায় যে সামরিক বাহিনী চুক্তির মূল নীতিগুলিকে অগ্রাহ্য করে বারবার বেসামরিক এলাকা দখল ও বেসামরিকদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার, ফেডারেল গণতন্ত্র বাস্তবায়ন এবং দেশের সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার দাবি জানায় এবং তাদের দাবি পূরণ না হলে সংলাপ হবে না বলে জানায়।

সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০২২ সালের মে মাস থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দশটিই এ ও’র সাথে তিন দফা শান্তি সংলাপ আহ্বান করে এবং এই শান্তি আলোচনার ফলে চারটি সাধারণ চুক্তিহয়। দেশব্যাপী যুদ্ধ বিরতি চুক্তির অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে রাজ্য প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় ঐক্য ও শান্তি প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান, প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অংহ্লাইং তার বক্তব্যে আট বছ রআগে এনসিএতে অংশ নেয়া জাতিগত নেতাদের যারা চুক্তি স্বাক্ষরে অবদান রেখেছিলেন তাদের সবাইকে আন্তরিক ও উষ্ণ শুভেচ্ছা জানায়। এ নসিএ অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের ৩৫ জন সদস্য, বেসরকারি সংস্থার ১১ জন কর্মকর্তা এবং ৩২ জন কূটনীতিক অংশগ্রহণ করে। থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী, ভারতের উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিক্রম মিসরি এবং এশিয়ান বিষয়ক চীনের বিশেষ দূত দেং জিজুন এই চুক্তির পক্ষে সমর্থন মূলক মন্তব্য করেছিলেন। থাইল্যান্ড মিয়ানমারের জাতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ও এই চুক্তিটিকে মিয়ানমারের জন্য শান্তি প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করে। থাইল্যান্ড বিশ্বাস করে যেকোনও দেশে শান্তির পথ তার নিজস্ব জনগণ দ্বারা নির্ধারণ করা উচিত এবং মিয়ানমারের সবপক্ষকে এই পথে চলার জন্য থাইল্যান্ড আহ্বান জানায়।

প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও চায় মিয়ানমারে শান্তি ফিরে আসুক এবং একই সাথে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হউক। বাংলাদেশের কক্সবাজারের ক্যাম্প গুলোতে আশ্রয় নেয়া সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার পাশাপাশি প্রতি বছর ৩৩ হাজার করে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। গত ছয় বছরে প্রায় দুই লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন, অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে দেড় শতাধিক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে।২০১৯ সাল থেকে এপর্যন্ত ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে আরসার সদস্য করা হয়ে ছিল যাদের অধিকাংশই এখন আরসা ছেড়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে ৭৩ জন আরসার অস্ত্রধারী সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হওয়ায় আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গা তরুণ-যুবকেরা মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসে জড়াচ্ছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার মধ্যদিয়েই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। বর্তমানে চীনের মধ্যস্থতায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে। ক্যাম্প থেকে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের প্রথমে ট্রানজিট কেন্দ্রে আনার পর প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাদেরকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হবে। নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা পেলে মিয়ানমারে ফিরতে রাজি অধিকাংশ রোহিঙ্গা। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানায় যে, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যেকোনো সময় এই প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে এবং স্থলপথ ও নাফ নদী পথে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলবে ।

যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সংকটে সহায়তা প্রদানে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী আফরিন আক্তার ১৭ অক্টোবর উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করে জানা য়যে, যুক্তরাষ্ট্র জোর করে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ তৈরির পরই কেবল স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন সম্ভব। জোর করে কিংবা বাধ্য করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছে।

মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে রাখাইনে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা পেলে রোহিঙ্গারা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরতে চায়। কিন্তু এখন যে প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ফিরে যেতে বহু বছর লাগবে। রোহিঙ্গারা এক সঙ্গে বড় দলে ফিরলে রাখাইনে ভালভাবে থাকতে পারবে বলে মনে করে অনেক রোহিঙ্গা। ভবিষ্যতে যাতে তাদের কেনি পীড়নে শিকার হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে না হয়, সেই নিশ্চয়তাও চায় রোহিঙ্গারা। চলমান প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও গ্রহণযোগ্য করতে এর সাথে ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকেও সম্পৃক্ত করা দরকার বলে অনেকে মনে করে।

মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে গণতন্ত্রকামী দলগুলো এবং প্রতিবেশী দেশ ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোকে সাথে নিয়ে গঠনমুলক ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া গেলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। বাংলাদেশ সব সময় মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক এটাই চায়। একই সাথে বাংলাদেশ আশা করে যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে রাখাইনে তাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার মাধ্যমে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় অবদান রাখবে।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর