শ্বেত বিপ্লবেও ডিম আমদানি কেন?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-10-05 09:41:31

দুধ, ডিমকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষিতে শ্বেত বিপ্লবের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল বহু বছর আগে। পশুপাখি নির্ভর এ দুটি মূল্যবান খাদ্যপণ্য সেই ঘোষণার পথ ধরে দেশীয় বাজারে বেশ সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। ক’বছর আগে দুধের দাম এতটাই কমে গিয়েছিল যে, ডেইরি খামারিরা রাস্তায় দুধ ঢেলে এর প্রতিবাদও করেছিল। বিগত কয়েক বছর অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষিফিডের দাম কম থাকায় ডিম ও ব্রয়ালার মুরগির দাম অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কৃষি উৎপাদনে নয় বরং উৎপাদিত কৃষিপণ্যে একশ্রেণির অতি মুনাফা লোভী কর্পোরেট ব্যবসায়ীর কুনজর পড়ায় দেশের নিত্য খাদ্যপণ্যের বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

আমাদের দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে কৃষকের তেমন কোন লাভ হয় না। কারণ, উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীদেরও তেমন কোন লাভ হয় না। কারণ তারা উচ্চমূল্যে পাইকারী বাজার থেকে সেগুলো কিনে আনতে বাধ্য হন। তারা খুচরা বাজারে একটু দাম বাড়ালে ক্রেতারা প্রতিবাদ করেন। সেসব কথা সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ভোক্তা অধিকার বা সংশ্লিষ্ট নির্দেশিত হওয়া সরকারী বাহিনী দ্রুত হাজির হয়ে খুচরা বিক্রেতাকে জরিমানা করেন অথবা জেলে পুরে দেন। অন্যদিকে নাগালের বাইরে থেকে যায় পাইকারী সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্তভোগী কর্পোরেটের লোভী ব্যক্তিরা।

কারণ তারা সবসময় সরকারের অতি কাছের মানুষ সেজে মিলেমিশে থাকেন। কর্পোরেটের এসকল লোভী ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া প্রভাবের মাধ্যমে সুকৌশলে গাছেরটা পেড়ে নিয়ে খাচ্ছেন আবার তলারটাও কুড়াতে পারঙ্গম। উভয়দিকে তাদের লাভ। তোয়াজ-তোষণ, তদ্বির সবকিছুই তাদের করায়ত্তে! সবসময়। তারা সরকারের উচ্চমহলের সাথে চলাফেরা করেন, সেমিনারে বসেন, নীতি নির্ধারণে পরামর্শ দেন। চাটুকারিতা করে বক্তৃতা দেন আবার সুকৌশলে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেন। এমনকি প্রচলিত দেশীয় যেসব পণ্য আমদানি করা হলে দেশের কৃষক বা উৎপাদনকারীরা স্বর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসে যাবে সেসব পণ্য আমদানি করার জন্য সরকারকে কুপরামর্শ দিয়ে বিভ্রান্ত করে তোলেন।

দেশে কি ডিমের অভাব পড়েছে? দেশে কি ডিমের মজুদ ও সরবরাহ কম? সকল বাজারে ডিমভর্তি হাজার হাজার খাঁচা সাজানো থাকে। এমনকি পাড়ায় পাড়ায়, ঘরের পাশের দোকানে সাজানো থাকে ঝুড়িভর্তি ডিম-সবসময়। ডিমের আড়তে কোন অসঙ্গতি নেই, সরবরাহে কোন অভাব নেই। অভাবটা অন্যজায়গায়!

জানা গেছে দেশের বাজারে ডিমের অভাব না থাকা সত্ত্বেও লোভী কর্পোরেটের কারসাজিতে ডিম আমদানিতে সায় দিয়েছে সরকার। বহুদিন ধরে পশুসম্পদমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী এই সুপারিশে সাড়া দেননি। কারণ এই আন্ডারগ্রাউন্ড পরামর্শে বিদেশি আন্ডা আমদানির সংগে দেশীয় পোল্ট্রিশিল্প অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং দেশীয় ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সকল খামারির ক্ষতি হবার সম্ভাবনা প্রবল। এই ডিম আমদানির ঘোষণায় দেশীয় খামারিরা চরম বিপদের আশঙ্কা করে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। অথচ, কর্পোরেটের ব্যবসায়ীরা খুশিতে বগল বাজাচ্ছেন।

কারণ দেশের জনগণের মাত্র একদিনে ভোগ করার সমান চারকোটি ডিম আমদানি করে কার্যত: তারা সরকারের মাধ্যমে দেশের খামারি ও আপামর জনগণকে ভয় দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। বৃহৎ খামার মালিক যারা এসব কর্পোরেটের সাথে জড়িত তাদেরকে আরো সহায়তা করে পক্ষান্তরে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরকে ধ্বংসের পাঁয়তারা শুরু করেছেন।

আমদানিকৃত ডিম বার্ডফ্লুযুক্ত কি-না, হাঁসের, মুরগির, কচ্ছপের বা কুমিরের কি-না তা নিয়ে ঘোষণায় স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। এছাড়া আজকাল নকল প্লাষ্টিকের ডিম বা কারখানায় তৈরি কৃত্রিম ডিমে বাজার সয়লাব। এমন পরিবেশের মধ্যে বিদেশ থেকে ডিম আমদানির ঘোষণা দেশের মধ্যে আরেকটি ডিম্বকান্ডের রাজনৈতিক ইস্যু ছড়িয়ে দেবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে অচিরেই।

এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ডিম ও কৃত্রিম ডিম পরীক্ষা করার কোন সুব্যবস্থা ঘোষণার মধ্যে আসেনি। ভেজাল ও নিষিদ্ধ পণ্য বিশেষ করে ডিমের ক্ষেত্রে ভেজাল যাচাইকরণ প্রক্রিয়া খুব কঠিন কাজ। অন্য যে কোন শুকনো খাদ্যপণ্যের মতো ডিম আমদানি করা খুব সহজসাধ্য বিষয় নয়। গরম আবহাওয়া এবং ভঙ্গুরজাত পণ্যের আমদানিকারকগণ খুব ভয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ডিম আমদানি ও বাজারজাত করা কোন সহজসাধ্য কাজ নয়।

আমদানিকৃত ডিমের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যাবে। এবং এতে দেশীয় খামারিদেরকে আরো বেশি প্রতারিত করার সুযোগ তৈরি হয়ে যাবে। শুধু এটাই নয়- দেশের সকল খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়াভাবে তাদের কব্জায় চলে যাওয়ায় সরকার হা-হুতাশ করে কোন সুফল আদায় করতে পারছেন না। সরকারের কোন কথা, হুমকি-ধামকি তাদের কানে প্রবেশ করছে বলে মনে হচ্ছে না।

ভোক্তা অধিকারের উচিত খুচরা বিক্রেতাদেরকে অযথা হয়রানি না করা। তারা কেউ কেউ পাইকারদের নিকট থেকে ১০০ ডিম কিনে খুচরা বিক্রি করে সারাদিনে মাত্র ৫০ টাকা আয় করেন। তাই ম্যাজিস্ট্রেটদের উচিত খুচরা বিক্রেতা বা পুড়িয়া বিক্রেতাদেরকে গ্রেফতার না করা। বরং ধরা উচিত রাঘব বোয়ালদেরকে। যারা তাদের চোখ ধুলো দিয়ে পাশেই চলাফেরা করে। অথবা দামী রেস্টুরেন্টে বসে কফি খাওয়ার অফার দেয় সারাক্ষণ! আমাদের দেশ শুধু খাদ্যপণ্যই নয়- ইয়াবা বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একই ধরণের পরিস্থিতি, দূরদৃষ্টিহীনতা ও দুর্বলতা লক্ষ্যণীয়।

কিছু বিদেশি ডিম আমদানি কি বাজারে অস্থিরতা বা অগ্নিমূল্য সামলানোর আদৌ কোন ইতিবাচক সমাধান? আমাদের হঠাৎ ডিম আমদানির ঘোষণা কি পিঁয়াজের মতো বিদেশিরা উল্টো কর বসিয়ে মূল্যবৃদ্ধির বিড়ম্বনার ক্ষেত্র তৈরি করবে না? সেজন্য সরকারকে বিচলিত হয়ে হঠাৎ কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো বিড়ম্বনা তৈরি থেকে বিরত থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ, এসব কাজে যথার্থতা যাচাই, গবেষণার খুঁটিহীন নীতিনির্ধারকদেরকে সহজেই কাবু করে দিয়ে স্বার্থ হাসিলে তৎপর রয়েছে অতিমুনাফালোভী কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা।

তারা কিছুট মানবিক ভূমিকা পালনে এগিয়ে না এলে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সামলানো বা নিয়ন্ত্রণ করা দুরুহ কাজ। দেশের একজন মানুষ মানবিক হবার কথা বললে আর বাকীরা অমানবিক হয়ে উল্টোপথে চলতে থাকলে কোন ঘোষণাই কার্যকরী হবার উপায় নেই। কারণ তারা প্রচলিত পরিবেশে চারদিকে হীনতা খুঁজে বেড়াতে তৎপর হতে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়েও ভেজাল জিনিষ সংযুক্ত করতে নির্দেশিত হতে হতে নিজেরাও সেটা অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এজন্য কোন কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করা হারিয়ে ফেলেছে।

সুতরাং ডিম আমদানির ঘোষণা একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তাযুক্ত পদক্ষেপ বলে মনে হয় না। লম্বা মেয়াদে এই পদক্ষেপ দেশীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বাজারকে আরো অস্থিতিশীল আরো নাজুক করে দিতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে জনগণকে উস্কে দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলা করে জনভোগান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং ধনী, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদেরকে তোয়াজ করার পথ পরিহার করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যা চায় তাই করার পদক্ষেপ নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি ঢেলে সাজানো উচিত। দেশীয় দুধ, ডিমকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষিতে শ্বেতবিপ্লবের ইতিবাচক প্রবণতা ধরে রাখাই হবে আপাতত: উত্তম কাজ।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর