উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে উদাসীনতা আর কতদিন?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-16 13:13:45

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা উষ্ণায়ন নিয়ে হরহামেশা কথা হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, "আর উদাসিতা নয়। এখনই কিছু করুন, নাহলে সংকটের ঝুঁকিতে থাকুন!" মধ্য শরতে উষ্ণ পরিবেশে গরমে নাকাল মানুষ বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন সংকট ও ঝুঁকি।

ঝুঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে নগদে। বৈজ্ঞানিক তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালের গ্রীষ্মঋতু ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ। এই উষ্মতম প্রবণতার ধারা এখনও বিদ্যমান।শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১ আশ্বিন ১৪৩০ শরতকালের দ্বিতীয় ভাগের সূচনা হলেও বাতাস রুক্ষ। রোদ কড়া। গরমের দাপট অসহনীয়। মসৃণ পেলবতা-মাখা শারদীয় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না।

কারণ, চলতি বছর উষ্ণতম গ্রীষ্মকাল কাটাল পৃথিবী। এই তথ্য সামনে এনেছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ)।

তাদের দাবি, এই বছরের জুন থেকে আগস্ট মাস পৃথিবীর উষ্ণতম সময় ছিল। এটাই ছিল উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্মকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে সবচেয়ে উষ্ণ শীতকাল।

নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বিল নেলসন বলেছেন, ‘‘এই রেকর্ড তাপমাত্রা শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়। এটি বাস্তবে বিশ্বের ভয়াবহ পরিণতির কথা জানাচ্ছে। আমেরিকা ও কানাডায় দাবানল এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় বন্যা হয়েছে। চরম আবহাওয়া বিশ্ব জুড়ে জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করেছে।’’

জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাসে নাসার রেকর্ডে আগের যে কোনও গ্রীষ্মের তুলনায় এ বার ০.২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা ছিল। আগস্টের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এনওএএ-র প্রধান বিজ্ঞানী সারাহ ক্যাপনিকের আশঙ্কা, ‘‘মনে হচ্ছে, সামনের বছরগুলিতে এই সব রেকর্ড ভেঙে যাবে।’’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাপমাত্রায় বিপজ্জনক বৃদ্ধি এড়াতে বিশ্বকে "দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে", এটাই বিজ্ঞানিদের সর্বসম্মত আর্জি। কিন্তু তাদের আবেদন কতটুকু গ্রাহ্য করা হচ্ছে? উষ্ণায়নের বিপদ থেকে উদাসীনতার মধ্যে চলছে সারা বিশ্ব।

নাসা'র আগেও জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক আন্তঃ সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। যেটা কিনা প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার থেকেও বেশি।

এতে বিপদ আসবে মারাত্মক আকারে। আবহাওয়া পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেবে বিশেষ করে চরম দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা সেইসঙ্গে লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। বাড়বে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই ও পরিবেশ দূষণ। বসবাসের পরিস্থিতি ভরে যাবে নানাবিধ সঙ্কুলতায়।

তাপমাত্রার এই সীমা অতিক্রম এড়াতে, বিশ্বের উচিত, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তন আনা। এসব হলো উষ্ণায়ন প্রতিরোধের একমাত্র পন্থা, যা বিজ্ঞানি ও গবেষকগণ বারবার উল্লেখ করছেন।

তারা বলেছেন, রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে জরুরি ভিত্তিতে নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে উষ্ণায়ন প্রতিরোধের জন্য। যাবতীয় পরিকল্পনা, প্রকল্প ও কর্মসূচি নিতে হবে 'উষ্ণায়ন কমিয়ে রাখার' নীতিকে সামনে রেখে। এমনকি, ব্যক্তিগত পর্যায়েও বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নয়, প্রত্যেকের একক প্রচেষ্টা বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে বড় ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান সমন্বয়কারী লেখক অরোমার রেভির মতে, "সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান কাজে লাগিয়ে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। তাই বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে বড় ধরণের পদক্ষেপ নিতে নাগরিক এবং ভোক্তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।"

গবেষকরা মানুষের প্রাত্যহিক জীবন থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন, যেগুলো মানুষ চাইলে চর্চা করে জলবায়ু পরিবর্তনে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারেন। এরমধ্যে প্রধান হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি ঘরেবাইরে সবদিকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে শিক্ষিত করে কাজে লাগানো।

সমাজতাত্ত্বিকগণ সবসময় বলেন যে, একটি টেকসই কমিউনিটি জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করা জরুরি। একটি অংশীদার-ভিত্তিক নেটওয়ার্ক গড়ে সমাজের মানুষ তা করতে পারে। এতে বিভিন্ন সম্পদ ও বিপদ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যায় এবং একযোগে লড়াই করার প্রচেষ্টা নেওয়া যায়। একটি সবুজ জীবনযাত্রার মান অর্জন করার জন্য সমাজে বসবাসকারী মানুষের এরূপ সংঘবদ্ধতা অপরিহার্য।

সবুজ জীবনযাত্রার লক্ষ্যে সমাজে বসবাসকারী মানুষ সংঘবদ্ধতার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো যখন প্রতিদিন অনুশীলন করবে, তখন তারা বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের মতো বিপদ সহনশীল পর্যায়ে রাখতে পারবে এবং সমাজের টেকসই পরিবেশগত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে: ১) সচেতন হয়ে, ২) গাছ না-কেটে, ৩) বৃক্ষরোপণ করে, ৪) নদী, পাহাড়, বিল, ঝিল তথা প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও অটুট রেখে, ৫) যান্ত্রিক জীবনকে কমিয়ে রেখে, ৬) জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে, ৭) ব্যক্তিগত বৈদ্যুতিক সামগ্রী তথা মোটরগাড়ি, এসি, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার কমিয়ে, ৮) শিল্প ও কলকারখানা বর্জ্য ও ধুয়া পরিমিত রেখে, ৯) কেমিকেলের ব্যবহার ও পোড়ানো ক্রমশ বন্ধ করে, ১০) প্রাকৃতিক জীবনের সান্নিধ্যে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ সৃজন, লালন ও চর্চার মাধ্যমে।

এইসব সচেতনতা ও তৎসংশ্লিষ্ট কার্যকলাপ অবশ্যই অচেতন বা উদাসীন থেকে প্রতিপালন করা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের মধ্যে উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে উদাসীনতা আর কতদিন চলবে, এটাই এক বিপদজনক প্রশ্ন।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর